ঢাকা: ‘এক ঘণ্টা সময়, বাড়ি ছেড়ে দিন। না ছাড়লে অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হব’; কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই এক মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের এমনভাবেই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে ম্যাজিট্রেট ও পুলিশ সদস্যরা।
আর এই পরিবারটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বীরবিক্রম মহিবুল্লাহর পরিবার। ঈদের আগে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করায় পরিবারটি এখন বিপাকে পড়েছেন। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবাসস্থল ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন শহীদ পরিবারটির।
মঙ্গলবার (২৭ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে 'শহীদ মুহিবুল্লাহর (বীর বিক্রম) পরিবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় বাস্তুচ্যুত হওয়া পরিবারটি নিজেদের আবাসস্থল ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনের সঞ্চালনা করেন শহীদ বীর বিক্রম মুহিবুল্লাহর বড় ছেলে মো. আলাউদ্দিন। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন শহীদ মহিবুল্লার ছোট ছেলে সালাউদ্দিন জুয়েলের স্ত্রী উম্মে জোহুরা মৌসুমি। তিনি বলেন, গত ২৬ জুন বেলা দেড়টার দিকে কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই ম্যাজিট্রেট, পুলিশ ঘরের দরজায় মোকদ্দমা ০১/২০২৩ জেলা প্রশাসকের আদেশ হাতে ধরিয়ে দেন। পরে বলেন ‘এক ঘণ্টা সময়, বাড়ি ছেড়ে দিন। না ছাড়লে অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হব’।
উম্মে জোহুরা মৌসুমি বলেন, এ সময় আমার স্বামী সালাউদ্দিন জুয়েল বাড়ি ছাড়তে রাজি হননি। তখন তাকে শারীরিক আঘাত করে হাতকড়া পড়িয়ে টেনে হেঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে উঠিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, এরপর আমিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হই। আমাদের তখন মনে হয়েছে আমরা দেশের কোনো দেশদ্রোহী বা দাগী কোনো আসামির সন্তান। নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আমার শহীদ বাবার প্রতি আমার যে গর্ববোধ নিমিষেই তা আমি উড়িয়ে যেতে দেখেছি।
জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তের প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ম্যাজিট্রেট বলেছেন, বাড়িটিতে অন্য আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ আজিজ কে ২/৩ অংশ মালিকানা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, তার মালিকানা প্রতিষ্ঠায় আমাদেরকে কেন বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার প্রয়োজন হল? ওখানে তো সরকারের অর্থাৎ, জেলা প্রশাসক ঢাকার নামেও ১/৩ অংশ জায়গা রয়েছে। ভূমি বন্দোবস্ত নীতিমালায় তো বরাদ্দ প্রদানে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় এক নাম্বারে রেখেছেন, আমরা কি সরকারি অংশে থাকার অধিকার রাখি না? মাননীয় জেলা প্রশাসক কি সরকারি খাস সম্পত্তির অংশ থেকে আমাদের উচ্ছেদ বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারতেন না?
সংবাদ সম্মেলনে শহীদ বীর বিক্রম মহিবুল্লার বড় ছেলে মো আলাউদ্দিন বলেন, একই দেশে মানবিক বিষয় বিবেচনায় এনে শিল্প সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখায় নায়িকা সুজাতাকে বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। অন্যদিকে, যাদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই শহীদ পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টিতে কি জাতির বিবেক নাড়া দেয় না? জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার মতো এক শহীদ পরিবারের আবেদন, আমাদের আবাসস্থল আমাদের ফিরিয়ে দিন।
তিনি দাবি করেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেরও আগে ১৯৬৯ সালে আমার বাবা মরহুম শহীদ মহিবুল্লাহ বীরবিক্রম পরিত্যক্ত এক নম্বর নর্থব্রুক হল রোড এ বসবাস গড়ে তোলেন। সেখানে আমার জন্ম, আমার ছোট ভাই সালাউদ্দিন জুয়েলের জন্ম। ছোট ভাই জুয়েলের জন্মের কথা আমার বাবা যুদ্ধের ময়দানে শুনেছেন। কিন্তু আমার ভাই ও আমি বাবাকে দেখতে পাইনি। বাবাও আর আমাদের দেখতে পাননি। তিনি দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
তিনি আরও দাবি করে বলেন, ১৯৮১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আমাদের রাষ্ট্রের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে বাড়িটি আমাদের দেওয়ার আদেশ দেন। পরবর্তীতে আমার স্বামী হারা অসহায় মা নাবালক সন্তানের মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বাড়িটি পেতে বিভিন্ন জায়গায় তদবির করেন। রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া তিনি কোনো রেজিস্ট্রি করে নিতে পারেন নি। ২০০০ সালে মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকে চলে যান। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে আমরা এ বাড়িতে বসবাস করছি।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন শহীদ মহিবুল্লার বড় ছেলের স্ত্রী তাসলিমা আফরিন, বড় ছেলের প্রথম সন্তান উম্মে রোমান আদিবা, দ্বিতীয় সন্তান সারা আশিফা, তৃতীয় সন্তান আয়শা সিদ্দিকা নূরসহ মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডার সন্তান সেলিম রেজা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৪ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৩
ইএসএস/এসআইএ