ঢাকা: রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও বর্তমানে সারাদেশেই বাড়ছে এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। ঢাকার মতো ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা ও হুমকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার দক্ষিণ এবং উত্তর সিটি করপোরেশনে যে পরিমাণ বরাদ্দ এবং সক্ষমতা রয়েছে, তা দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনের নেই। সেই ঢাকাতেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সেখানে দেশের অন্যান্য স্থানে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লে তা কতটা ভয়াবহ হবে সেটাই ভাবনার বিষয়।
সোমবার (১০ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক তথ্য থেকে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় এ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নতুন ৮৮৯ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন ভর্তি রোগীর ৫৭৪ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ৩১৫ জন ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর মোট ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে ৫৯ জন এবং ঢাকা মহানগরের বাইরে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বর্তমানে সারাদেশে সর্বমোট তিন হাজার ২৫৩ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দুই হাজার ৮০ জন এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার ১৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ১৩ হাজার ৮৪৩ জন ডেঙ্গু-রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় নয় হাজার ৬৬৪ জন এবং ঢাকার বাইরে চার হাজার ১৭৯ জন হয়েছেন।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের ডেঙ্গুর হট স্পট ম্যানেজমেন্ট করা দরকার। ডেঙ্গু রোগীদের ঠিকানা বের করে, ওই ব্যক্তির বাড়ির আশপাশে ফগিং করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। এই উড়ন্ত মশাগুলোই এই মুহূর্তে ইনফেক্টেড মশা, এই মশাগুলো যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু ছড়াবে। নগরবাসীদেরও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সম্পৃক্ত হতে হবে। বাসা বাড়ির ছাদে, আঙিনায় কিংবা অন্য কোনো স্থানে এডিস মশা জন্মাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা আশঙ্কা করছি, আগামী মাসে সারা বাংলাদেশের সবকটি জেলায় ডেঙ্গু ছড়াবে। ফলে প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু প্রিভেনশনের প্রস্তুতি রাখা দরকার।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ডেঙ্গু বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকায় ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু হচ্ছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ পরিচালনা করছে। তাই ঢাকায় ডেঙ্গুর বিষয়ে আমাদের কিছুটা ধারণা রয়েছে। এই ধারণা দেশের অন্যান্য জায়গার ক্ষেত্রে নেই। এ ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের স্থানগুলোতে অধিকমাত্রায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লে, তা নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
তিনি বলেন, আগে ডেঙ্গু একটা সিটিতে ছিল। তাই একটা জায়গায় মনোযোগ দেওয়া, নিয়ন্ত্রণ করা সহজ ছিল। এখন বলতে গেলে সারাদেশেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও ডেঙ্গু হচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণে জেলা কিংবা ও উপজেলায় বলতে গেলে তেমন কোনো সক্ষমতা নেই। জেলা, উপজেলা ও পৌরসভাগুলো হয়তো কোনো রকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিন্তু অনেক ছোট পৌরসভায় সেই সক্ষমতা নেই। ফলে তাদের পক্ষে ভেক্টর কন্ট্রোল (এডিস মশা) নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগের ডায়াগনোসিস এবং ম্যানেজমেন্ট দুটোই দুর্বল। যদি গ্রামের কম অবস্থা সম্পন্ন কোনো লোক ডেঙ্গু আক্রান্ত হন, তার পক্ষে বড় হাসপাতাল কিংবা ঢাকায় এসে সেবা নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে ডেঙ্গুতে বহুমাত্রিক সমস্যা বাড়ছে। আশঙ্কা করছি, ভবিষ্যতের দিনগুলোতে ডেঙ্গু ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিবে। আমরা যেভাবে সংক্রামক রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম, বড় কোনো সংক্রামক রোগ দেশে ছিল না বললেই চলে। সেখানে এখন ডেঙ্গু ভয়াবহ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ২৩ বছরে আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না, এটা আমাদের ব্যর্থতাই বলা যায়।
ঢাকার বাইরে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের ডেঙ্গুর শনাক্তের জন্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার সক্ষমতা কতটুকু জানার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে কারও ফোন বন্ধ, আবার কারও ফোন চালু থাকলেও রিসিভ করেন নি।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৬ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০২৩
আরকেআর/এসআইএ