ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

নিজের কিডনি খুইয়ে গড়েন চক্র, চার বছরে অর্ধশতাধিক কিডনি বিক্রি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২৩
নিজের কিডনি খুইয়ে গড়েন চক্র, চার বছরে অর্ধশতাধিক কিডনি বিক্রি

ঢাকা: ‘২০১৯ সালে চিকিৎসার জন্য ভুয়া কাগজপত্রে ভারতে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে নিজের একটি কিডনি বেঁচে দেন আনিছুর রহমান। সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যাপক চাহিদা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে দেশে ফিরে নিজেই নামে কিডনি বেচাকেনার অবৈধ ব্যবসায়।

ভারতের কিডনি কেনাবেচার চক্রের সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র গড়ে তুলেন আনিছুর।

অনলাইনে বিত্তশালী কিডনিরোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহ করে বৈধ ও অবৈধভাবে বিমানে বা স্থলপথে ভারতে পাঠাতেন তিনি। ’
‘দেশে সক্রিয় অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচার চক্রের অন্যতম মূলহোতা মো. আনিছুর রহমানসহ (২৯) জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর এ কথা জানিয়েছে র‌্যাব-১।

গ্রেপ্তারকৃত বাকিরা হলেন, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে রাজিব (৩৩), সালাউদ্দিন তুহিন (২৭), এনামুল হোসেন পারভেজ (ডোনার) এবং সাইফুল ইসলাম। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা তৎপরতার ধারাবাহিকতায় রাজধানীর ভাটারা, বাড্ডা, বনানী ও মহাখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা এবং ভুক্তভোগীর সঙ্গে করা চুক্তির এফিডেভিট কপি উদ্ধার করা হয়েছে। আনিছুরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‍্যাব জানায়, এখন পর্যন্ত তার মাধ্যমে ৫০ এর বেশি কিডনি কেনাবেচা হয়েছে। ’

বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাব-১ অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ।



তিনি বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে প্রলুব্ধ হয়ে সর্বহারা হচ্ছে অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ।

জানা যায়, বিদেশে অবস্থানরত একেকজন কিডনি ক্রেতা জীবন বাঁচাতে ৪৫-৫০ লাখ টাকা খরচ করে কিডনি কিনেন। অথচ ওই টাকার ৪-৫ লাখ টাকা পায় প্রতারিত ডোনার। ৫-১০ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা হয় দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় দালাল, অসাধু ট্রাভেল এজেন্ট এবং অন্যান্য প্রতারকদের মধ্যে। বাকি প্রায় ৩০ লাখ টাকা পায় বিদেশে অবস্থানরত কিডনি পাচার সিন্ডিকেট।

র‍্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র সীমার নিচের অসহায় মানুষগুলোকে টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে ওই চক্র। কখনও তারা বলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে একটির বেশি কিডনি দরকার নেই, কখনও মিথ্যা আশ্বাস দেয় যে চিকিৎসার খরচ তারা বহন করবে। টাকার লোভে কিডনি হারিয়ে প্রায়ই অকর্মণ্য হয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে অসহায় মানুষগুলো।

বুধবার (১৯ জুলাই) বিকেল চারটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মূলহোতা আনিছুর রহমানসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

কিডনি চক্রের কার্যক্রম সম্পর্কে র‌্যাব-১ অধিনায়ক বলেন, চক্রটি চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে।  

দেশে থাকা মূলহোতা আনিছুর ঢাকায় বসে বিদেশে ডোনার পাঠানোর বিষয় তদারকি করে। চক্রের তৃতীয় দলটির সদস্য আরিফ এবং তুহিন প্রথম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে।

পরবর্তীতে ঢাকার বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন প্রত্যাশী রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে, চতুর্থ গ্রুপটির হোতা ‘সাহেবানা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের’ মালিক সাইফুল ইসলাম প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভুক্তভোগী ডোনারাকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, অন্য কোনো চক্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আমরা পায়নি। তবে দেশের অভ্যন্তরে তারা দীর্ঘদিন ধরে কিডনি বেচাকেনা নিয়ে কাজ করছিল। চক্রটি এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে কিডনি নিয়েছে।

মূলত এসব চক্র মোবাইলফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার কাজ করে আসছে। আমরা বেশ কিছু পেজ নজরদারি করছি; ধারণা করছি এসব কাজে আরও বেশ কিছু চক্র জড়িত রয়েছে।

কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা অন্য কেউ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না আমরা এমন কাউকে পাইনি। তাদের কাছে যেসব কাগজপত্র পেয়েছি সেগুলো জাল। এগুলো জাল-জালিয়াতির মাধ্যমেই তৈরি করেছে যা দিয়ে ভিসা পাওয়ার ব্যবস্থা করতো। এর সঙ্গে কোনো হাসপাতালের সম্পৃক্ততা পাইনি।

একেক জনের সঙ্গে একেক ধরনের চুক্তি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করতো। সেই টাকা কীভাবে ভাগ হতো? এমন প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাক আহমেদ বলেন, জানা গেছে- প্রাথমিকভাবে ৫০ লাখ টাকা চুক্তি হতো। সেই টাকার মধ্যে যিনি কিডনি দিতেন তিনি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেতেন। বাকি টাকা চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে বণ্টন হতো।

সম্প্রতি সরকারি একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে দেশের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনে প্রতারণার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। এ প্রতারণার সঙ্গে চক্রটি জড়িত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের জড়িত থাকার এমন কোনো তথ্য আমরা পায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২৩
পিএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।