ঢাকা, শুক্রবার, ৫ পৌষ ১৪৩১, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

অর্থ লোপাটের পর বিদেশ পাড়ি, ‘পলাতক’ বেবিচক কর্মকর্তাদের আছে বাড়ি-গাড়ি

মাছুম কামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩
অর্থ লোপাটের পর বিদেশ পাড়ি, ‘পলাতক’ বেবিচক কর্মকর্তাদের আছে বাড়ি-গাড়ি

ঢাকা: ব্যাপক অর্থ দুর্নীতির পর ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা এখন ‘পলাতক’।

কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ নিয়ে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে মামলা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না। যদিও তারা দাবি করেন, বেবিচকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি করলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে!

জানা গেছে, ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির পর ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন বেবিচকের অন্তত ৫ কর্মকর্তা। আজ পর্যন্ত তারা কর্মস্থলে তো নয়, দেশেও ফেরেননি। আবার কেউ কেউ লিয়েনে গিয়ে ফিরছেন না। পলাতক এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই বিদেশে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করে বাড়ি-গাড়ি করার অভিযোগ উঠেছে।

যার যার বিরুদ্ধে অভিযোগ-
মো. ইখতিয়ার ইসলাম ছিলেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ প্রকৌশলী। তিনি ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের শর্ত সাপেক্ষে লিয়েনে কানাডা গেছেন। ২০২২ সালের ১৩ মার্চ লিয়েনের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু তিনি দেশে ফেরেননি। স্বপদে কাজে যোগদান না করে কানাডার টরেন্টোয় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের মাধ্যমে নতুন করে দুই বছর লিয়েন বৃদ্ধির আবেদন করেন। তবে কর্তৃপক্ষ সেটি অ-বিবেচিত বলে মত দেয়।

অনুমতিসহ দেশ ত্যাগ করে বিনা অনুমতিতে অনুমোদিত সময়ের পর গত ২০২২ সালের ১৪ মার্চ থেকে বিদেশে অবস্থান করতে থাকেন ইখতিয়ার ইসলাম। এতে এতে কর্তৃপক্ষের কাজে বিঘ্ন ঘটে। লিয়েন পুনর্বিবেচনা বিষয়ে আবেদন অগ্রহণযোগ্য হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। পরে মামলার তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর বিধি ৪৯(গ) অনুযায়ী ‘পলায়নের’ দায়ে জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ প্রকৌশলী মো. ইখতিয়ার ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বেবিচকের অর্থ লোপাটের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে

বেবিচক সদর দপ্তরে প্রকৌশল বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মো. শহীদুজ্জামান। দায়িত্বপালন সময়ে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন তিনি। কিন্তু ছুটি শেষ হলেও তিনি দেশে ফিরছিলেন না। তাই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বেবিচক। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ ও পলায়নের অভিযোগ এনে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়।

মামলাটি তদন্তে শহীদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। পরে তাকে সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) হিসেবে পদাবনতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া আদেশের তারিখ পর্যন্ত অননুমোদিত ছুটিকে বিনা বেতনে অসাধারণ ছুটি হিসেবে মঞ্জুর করে বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি ও সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু, তারপরও শহীদুজ্জামান কাজে যোগ না দিয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে শারীরিক অসুস্থতার দুটি আবেদন পাঠান বেবিচকে। সেটি নাকচ করে তার বিরুদ্ধে আবারও বিভাগীয় মামলা করা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও পলায়নের অভিযোগ সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর বিধি ৪৯(গ) অনুযায়ী পলায়নের দায়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। শহীদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বেবিচকের বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত ১০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।

চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করে বেবিচক। আবদুল খালেক তার স্ত্রীর বড় ভাইকে দেখতে দুই মাসের ছুটি নিয়ে ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর কানাডায় যান। কিন্তু ছুটি শেষে তিনি দেশে ফেরেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেবিচকের এই প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে সরকারি ৭ হাজার ৮৩০টি পে-অর্ডার উদ্ধার হয়, যেগুলো তিনি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে রেখেছিলেন। ২০ ক্যাটাগরিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল পে-অর্ডারগুলো। কিন্তু আবদুল খালেক বেবিচকের হিসাব শাখায় জমা না দিয়ে সেগুলো নিজের ড্রয়ারে রেখে দেন। অন্তত, ১০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও।

যুক্তরাজ্যে স্বামীর কাছে যেতে দুই মাসের ছুটি নিয়ে ২০২১ সালের ১৪ জুন যুক্তরাজ্যে যান বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের লাইব্রেরিয়ান তানিয়া আক্তার। এরপর আর ফেরেননি। দীর্ঘ ১৯ মাস চিঠি চালাচালির পর তাকেও বরখাস্ত করা হয়।

এদিকে, যশোর বিমানবন্দরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলমকেও খুঁজে পাচ্ছে না বেবিচক। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাঁচ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি (ক্যাজুয়াল লিভ) নিয়ে নিজ বাড়ি পাবনায় যান মাহবুব। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও আর কর্মস্থলে ফেরেননি। এ বিষয়ে ২২ নভেম্বর তাকে নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য তলব করে বেবিচক। তার বাসায় চিঠি পাঠানো হয়; ম্যাসেজ দেওয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপেও। সেসময় তাকে সাতদিনের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হলেও তিনি আসেননি। তার অবস্থানও শনাক্ত করতে পারেনি বেবিচক। দুর্নীতির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধেও।

কী ব্যবস্থা নেয় বেবচিক?
সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, চাকরিবিধি ভঙ্গ, অনিয়মকারী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ১৮টি বিভাগীয় মামলা চলমান ছিল। এ মাসটিতে কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। আবার নতুন করে মামলা রুজুও হয়নি। এর মধ্যে ১৩টি মামলার সঙ্গে আবার আদালতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ফৌজদারি এই মামলাগুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। বাকি ৫টি বিভাগীয় মামলার মধ্যে বেশিরভাগ জবাব দাখিল ও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেবিচকের অনেকেই দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে বিদেশে সটকে পড়ছেন। বিদেশে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে স্থায়ী চাকরিচ্যুতির শাস্তি ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংস্থাটি। এতে সংস্থাটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, কেউ দুর্নীতি করে দেশের বাইরে চলে গেলে সে আর ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে না। একটা অভিযোগ সামনে আসার পর দাপ্তরিক জটিলতার সুযোগে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তারা পায়। যে-ই দুর্নীতির সাথে জড়িত, তার বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

 পলাতক কাউকে চাকরিচ্যুত করাই কার্যকর হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদুল আলম বলেন, চাকরিচ্যুত করলেই যদি হয়ে যেত, তাহলে তো এ ধরণের ঘটনা ঘটত না। কেউ দুর্নীতি করার পর তাকে শুধু চাকরিচ্যুত করাই যদি শাস্তি হয়, তাহলে তো দুর্নীতির টাকা দিয়ে বাকীজীবন সে স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারে। কাজেই এ দুর্নীতি করে বিদেশ পালিয়ে যাওয়াদের ব্যাপারে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

‘অভিযুক্ত’ ও ‘পলাতকদের’ সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে বাংলানিউজ। কিন্তু তাদের কোনোভাবেই পাওয়া যায়নি।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমানের সঙ্গেও বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। অবশ্য এর আগে তিনি গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছিলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে বেবিচকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩
এমকে/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।