ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

৮ আঙুল অবশ, তবুও এঁকেছেন ২০ হাজার ছবি!

এম এম ওমর ফারুক, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩
৮ আঙুল অবশ, তবুও এঁকেছেন ২০ হাজার ছবি!

নড়াইল: দুই হাতের আট আঙুলই অবশ সাখির। এ অবস্থাতেই এঁকেছেন প্রায় ২০ হাজার ছবি! নড়াইল শহরের অলি-গলিতে দেখা মেলে ওয়েস্টার্ন টুপি পরিহিত এই চিত্রশিল্পীর।

একে-ওকে মডেল বানিয়ে আঁকছেন ছবি। কলম দিয়ে লাইন ড্রইং করে ফুটিয়ে তুলছেন মুখমণ্ডলের চিত্র। শিশু কিংবা বৃদ্ধ যে-ই আবদার করছেন, তাকে বসিয়েই ৫ মিনিটে এঁকে ফেলেন মুখের লাইন ড্রইং।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নড়াইল শহরের নড়াইল গ্রামে সাখির বাড়ি। বাবার নাম মনিরুল জামান। বাবা মনিরুল ছিলেন চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের বন্ধু। সাখি তার বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় শিল্পীর বাড়িতে গিয়ে ছবি আঁকা দেখেছেন অনেক। তখন থেকেই তিনি মনে মনে ভাবতেন -‘যদি ছবি আঁকতে পারতাম’।  সাখি পরিবারের সঙ্গে থাকতেন যশোরে। সেখানেও ছিল শিল্পী সুলতানের যাতায়াত। কিশোর বয়সেই পেয়েছেন নানা ধরনের পরামর্শ।  

যশোর থাকাকালীন ১৯৯২ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন সাখি। ওষুধের প্রভাবে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যায়। ৫ বছর অসুস্থ থাকার পর ভারতে চিকিৎসার জন্য গেলে পাসহ শরীরের অন্য অঙ্গ ঠিক হলেও দুই হাতের ৮ আঙুল অবশ হয়ে যায়।

পরে ১৯৯৮ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন সাখি। বাউন্ডেলের মতো এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতেন। একটা সময় ছবি আঁকার প্রতি তীব্র ইচ্ছে জেগে ওঠে তার। মামাবাড়ি মির্জাপুর গেলে দেখা হতো খালাতো ভাই চিত্রশিল্পী গোলাম মোর্তজার সঙ্গে, সেই তাকে ছবি আঁকতে উৎসাহ দেন। রং তুলি ধরতে পারবে না বলে শিল্পী মোর্তজাই তাকে লাইন ড্রইংয়ের ধারণাটা দেন। এরপর থেকে ছবি আঁকা শুরু সাখির। অবশ ৮ আঙুলে প্রায় অচল হাতে তুলি ধরা আর রং কেনার টাকাও নেই সাখির। তাই কলম দিয়েই লাইন ড্রইং শুরু করেন।  

নড়াইলে সুলতানের বাড়ি, পুরাতন জমিদার বাড়ির পূজামণ্ডপে কিংবা বাধাঘাটে সবখানেই সাখির বিচরণ। সিগারেটে প্যাকেটে কিংবা পড়ে থাকা ঠোঙায় আকেন কলম দিয়ে। এটা আবার কেমন শিল্পী? কলম দিয়ে ছবি আঁকে, এ নিয়ে হাসাহাসি করতেন বন্ধু আর পরিচিতজনেরা। একদিন জমিদার বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে ছবি আঁকছিলেন এসএম সুলতানের শিষ্য শিল্পী কাজল মুখার্জী। সাখি চুপিসারে তার কাছে যান, একটি ছেঁড়া কাগজে কাজল মুখার্জীর মুখের ছবি আঁকেন কলম দিয়ে। শিল্পী কাজল মুখার্জী এটা দেখে অবাক হয়ে তাকে তার কাজ চালিয়ে যেতে বলেন।  

এরপর থেকেই কাজল মুখার্জীর সান্নিধ্যে চলে আসেন শিল্পী সাখি। এরপর চলতে থাকে সাখির শিল্পী হওয়ার সাধনা।  

২০১৩ সালে নিপ্পন চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের আয়োজনে জাপানে ‘এশিয়া প্যারা আর্ট’ প্রতিযোগিতায় তার পাঠানো ছবিটি ‘প্রথম স্থান’ অর্জন করে। শিল্পী এসএম সুলতানের লাইন ড্রইং করে পাওয়া পুরস্কারটি আনতে আমন্ত্রণ পেলেও টাকার অভাবে জাপানে যাওয়া হয়নি। তাইতো নড়াইলের বাধাঘাট, সুলতানের বাড়ি, ধোপাখোলা, শিল্পকলা, মুচিপোল এলাকায় ঘুরে বেড়ান আর মানুষের লাইন ড্রইং করে বেড়ান সাখি।  

সাখিকে তার মায়ের দেওয়া জমিতে একটি ঘর তুলে দিয়েছে পরিবার থেকে। কিন্তু বিবাহিত জীবন নিয়ে তার কোনো ইচ্ছা নেই, তাই একার সংসার। নিজে রান্না করতেও পারেন না, তাই হোটেলে হোটেলে খাওয়া আর ছবি আঁকা। কখনও টাকা না থাকলে হোটেলে বাকিতে খেয়ে পরে টাকা পেলে তা পরিশোধ করেন।  

সাখি এ পর্যন্ত এঁকেছেন প্রায় ২০ হাজার ছবি। ৫ মিনিটেই তার একটি ছবি শেষ হয়। ব্যক্তির ছবি একে ১০০-৫০০ টাকা দিলেই খুশি শিল্পী সাখি। অনেক বড় বড় মানুষের ছবি এঁকেছেন এই শিল্পী।  

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী সুলতান উৎসবে নড়াইলে আসেন। সময়-সুযোগ বুঝে তার মুখের একটি লাইন ড্রইং করে ফেলেন। এটি দেখে গওহর রিজভী অত্যন্ত খুশী হন এবং সাখির হাতের অবস্থা জেনে ব্যথিত হয়ে তাকে সরকারি ভাতা পাওয়ার আশ্বাস দিয়ে যান।  

শিল্পী সাখির নিজের জীবন নিয়ে আক্ষেপ না থাকলেও ক্ষোভ রয়েছে শিল্পকলা একাডেমির ওপর। এমনটাই জানিয়ে সাখি বাংলানিউজকে বলেন, আমাকে আশ্বাস দেওয়া পরও কেন দুস্থ শিল্পীর ভাতা পাই না? -তা জানি না! কত মানুষ, কত ধরনের সুবিধা নিচ্ছে অথচ আমার দিকে কেউ তাকায় না।  

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শরফুল আলম লিটু বাংলানিউজকে বলেন, দুই হাতের ৮ আঙুল অবশ হওয়ার পরও শিল্পী সাখি যেভাবে লাইন ড্রইং করেন, এটা সত্যিই অবাক করার মতো।  

নড়াইলের শিল্পকলা একাডেমিতে ২০১৭ সালে তার এসব ছবি দিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। ইচ্ছে আছে, একদিন ১০১টি শিশুর লাইন ড্রইং করবেন। তার সেই আশা পূরণ হবে কি না -তা কারও জানা নেই।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।