ঢাকা: মিরপুরে ঢাকা কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তি। টিনশেডের অন্ধকার ঘরে বসে বিলাপ করছেন কুলসুম বেগম।
এই ঘটনায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মোট চারজনের প্রাণ যায় বৃহস্পতিবার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়া কমার্স কলেজ সংলগ্ন সড়কে। মেয়ে, জামাই, নাতনি লাশ হয়ে পানিতে ভাসছে- দেখে ছুটে যেতে চাইলেও কেউ কুলসুমকে কাছে যেতে দিচ্ছিল না। সবাই বলছিল, পানিতে বিদ্যুৎ। যে যাচ্ছে, সে-ই মারা যাচ্ছে।
কুলসুমের মেয়ে মুক্তা বেগম, মুক্তার স্বামী মো. মিজান, মেয়ে লিমা, ৭ মাস বয়সী ছেলে হোসাইন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। তাদের উদ্ধার করতে যাওয়া মোহাম্মদ অনিকও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। তাদের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে হোসাইন ছাড়া কেউ বাঁচেনি।
টিনশেডের ঘরে কুলসুম বিলাপ করতে করতে জানান, দুপুরে মেয়ে-জামাই দুই সন্তানকে নিয়ে দাওয়াত খেতে এসেছিলেন। দুপুরে খেয়ে যদি বিদায় হতেন, যদি সন্ধ্যা পর্যন্ত না থাকতেন, তাহলে এভাবে তিনজনের মৃত্যু হতো না। কথা ছিল, দুপুরে খেয়েই চলে যাবেন। কিন্তু মেয়ের জামাই মিজান কথা বলতে বলতে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তখন তাদের আর ফেরা হয়নি।
সন্ধ্যা হচ্ছে দেখে কুলসুম হাতে থাকা টাকা একশ দিয়ে ডিম আর শুঁটকি কিনে আনেন। রান্না করে খাওয়ানোর পর রাত ৯টার দিকে বৃষ্টি কিছুটা কমে। পরে দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ে-জামাই বের হন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে কে যেন খবর দেন, মেয়ে মুক্তা, তার স্বামী মিজান, নাতনি লিমা আর নাতি হোসাইন মরে পানিতে ভাসছে। কুলসুম জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে কাছে গেলেও কেউ তাকে লাশের কাছে যেতে দেয়নি।
স্বামী আর দুই মেয়েকে নিয়ে টিনশেডের একটি ঘরে থাকেন কুলসুম। সেখানেই থাকা, খাওয়া ও রান্না। ছোট জায়গা হওয়ার কারণে মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনিতে রাখতে চাননি, বলতে বলতে হাত-পা ছাড়িয়ে বিলাপ করতে থাকেন কুলসুম।
এদিকে ছেলে, বউ, নাতনির একসঙ্গে মৃত্যুর খবর শুনে শোকে স্তব্ধ মিজানের বাবা নাসির হাওলাদার। তিনি বরিশালে থাকেন। রাত ২টায় খবর পেয়ে তখনই বের হন ঢাকার উদ্দেশে। সকাল ৯টার দিকে ঝিলপাড় বস্তিতে পৌঁছেন। রাতে যখন খবর পান, বুঝে উঠতে পারেননি এমনভাবে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবার চোখ মুছতে থাকেন তিনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে স্থানে চারজনের প্রাণ গেছে, তার পাশেই জামাল উদ্দিনের মুদি দোকান। পাশে দেয়াল কেটে বাড়ির পেছন থেকে বিদ্যুতের লাইন চলে গেছে সামনের রাস্তার ওপারে বস্তিতে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই- বাড়ির দেয়াল, ফুটপাত, সড়ক ও সড়ক বিভাজক কেটে নিচ দিয়ে বিদ্যুতের এমন লাইন নেওয়া হয়েছে। আশপাশের লোকেরা জানান, এ রকম চার-পাঁচটি চোরাই লাইন আছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাস্তাতে তখন কোমর পানি। ফুটপাতেও হাঁটু পানি। ফুটপাত দিয়ে জামালের দোকানের পাশে এলেই মো. মিজান, স্ত্রী মুক্তা আর দুই সন্তান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। তাদের উদ্ধার করতে যান মোহাম্মদ অনিক। তিনিও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। এতেই মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এই ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব দেশবাসী।
ঝিলপাড় বস্তিতে উপরে-নিচে টিনের ঘরে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী অনেক মানুষের বসবাস। এখানে নেই যাতায়াতের ঠিকঠাক রাস্তা। এখান বিদ্যুৎ-গ্যাসের বৈধ লাইন নেই। সড়ক ও ফুটপাত কেটে ওপার থেকে লাইন আনা হয়েছে। মৃত্যু সঙ্গে নিয়ে বস্তিবাসীদের বসবাস। চারজনের মৃত্যুর পর এ বস্তির অবৈধ লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি ৯৯৯ নম্বরে কল করে জানানো হয়। উদ্ধারকারীরা এর এক ঘণ্টা পরে আসেন বলেন ক্ষোভ প্রকাশ করেন বস্তির এক নারী দোকানদার। তিনি বলেন, পুলিশ দিয়া কী হইব। সাংবাদিক দিয়া কী হইব। উদ্ধার করতে আসে এক ঘণ্টা পর। সাংবাদিক আইসা আলোর ঝলকানি দিয়া চইলা গ্যাছে। আমগো কী হইছে!
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একসঙ্গে চারজন নিহতের ঘটনা পুরো বস্তিবাসীকে নাড়া দিয়ে গেছে। ঘরের সামনে, ভেতরে প্রতিবেশীরা কুলসুমকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেউ নির্বাক হয়ে ঘরের দরজায়, কেউবা পথে নির্বাক বসে আছেন। তবে কুলসুমের বিলাপ থামছেই না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩
জেডএ/আরএইচ