খুলনা: খুলনায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) সম্প্রচার কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির এক যুগ পার হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৫ মার্চ খুলনার খালিশপুর প্রভাতী স্কুল চত্বরের জনসভায় অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বস্তবায়নের ঘোষণার পাশাপাশি খুলনা টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর ঘোষণা দেন।
বিগত দিনে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ খুলনা সফরে আসলে খুলনায় পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র চালুর দাবিতে খুলনা সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কমিটি’র পক্ষ থেকে সার্কিট হাউজে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ২০২১ সালে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ খুলনা সফরে এসে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক তহবিল থেকে অনুদানের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃব্যে বলেন নির্বাচনের আগেই খুলানয় বিটিভি পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু হবে। এছাড়া খুলনার বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র চালুর দাবিতে একাধিক মানববন্ধন, স্মারক লিপি প্রদান করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচার কেন্দ্র চালু হলে খুলনার সাহিত্য-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে দারুণ পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন খুলনার সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠকরা।
অবকাঠামো উন্নয়ন, আধুনিক স্টুডিও ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও খুলনা থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিটিভি সম্প্রচার প্রক্রিয়া চালু হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও কেন্দ্রটি চালু না হওয়ায় খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মনে চেপে রাখা ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে।
সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রধানমন্ত্রীর ১৩ নভেম্বর (সোমবার) খুলনা সফরের সময় খুলনায় পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্রের নিয়মিত সম্প্রচার কার্যক্রম তাকে দিয়ে উদ্বোধনের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য বিটিভি কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানান। অথবা ওইদিন খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে যেন পূর্ণাঙ্গভাবে বিটিভি সম্প্রচার প্রক্রিয়া চালুর নির্দেশনা থাকে।
খুলনা সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক স্বপন গুহ বাংলানিউজকে বলেন, খুলনায় একটি পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপনের দাবি বহুদিনের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য এটা বাড়তি কোনো সুবিধা গ্রহণের দাবি নয়। এটা একটি জাতীয় প্রয়োজন। খালিশপুরে একটি টেলিভিশন উপকেন্দ্র রয়েছে যেখান থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে পরবর্তীতে সেখানে একটি অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়। একটি স্টুডিও তৈরির জন্য যন্ত্রপাতিও সংস্থাপিত হয়। সেখান থেকে দুটি ক্যামেরা ও প্যানেল বোর্ড অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সে সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক ম হামিদ নিজস্ব উদ্যোগে খুলনায় বিটিভির স্টুডিও তৈরি করেছিলেন। স্টুটিও তৈরি হওয়ার পর উদ্বোধনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল। ওই স্টুডিও থেকে কিছু সম্প্রচার হতো। টেস্ট করার জন্য আমরা বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম সম্প্রচার করতাম। তখন যে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি যারা ছিলেন তাদের উপস্থিত রেখেই সেগুলো করা হতো। এমন ভাবে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল যে একটি তারিখ ঠিক রেখে উদ্বোধন হয়ে যাবে। তারপর যখন দেখা গেলো উদ্বোধন করা হচ্ছে না মহাপরিচালক ম হামিদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল এরপর যারা আসলেন তারা এসে যে কাজটি করলেন তা খুবই দুঃখজনক। স্টুডিও থেকে ক্যামেরা নিয়ে গেলেন। বিভাগীয় কমিশনারকে বিষয়টি জানানোর পর তিনি রীতিমত চিঠি লিখলেন। তখন জানানো হলো বিটিভির আউটডোরে কিছু প্রোগ্রামের জন্য এগুলো নেওয়া হয়েছে আবার পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
স্বপন গুহ বলেন, খুলনায় বিটিভির সম্প্রচার কেন্দ্র করার প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে কিন্তু সেই প্রকল্পের কাজ এখনও শুরু হয়নি। আমরা খুলনা কেন্দ্রের কথা যখনই বলছি তখনই বলা হচ্ছে নতুন প্রকল্প হচ্ছে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। আমাদের যারা নেতৃত্বে আছে তারা বিষয়টি নিয়ে তেমন কথাই বলেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুলনা সফরের সময় বিষয়টি উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো।
কবি ও আবৃতিশিল্পী কামরুল কাজল বলেন, খুলনায় একটি পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপনের দাবি কোনভাবেই পূরণ হচ্ছে না। দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশে বিটিভির খুলনা কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী চাইলে খুলনাতে একটা পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র হবে। তাই বিটিভির খুলনা কেন্দ্র চালুর ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন।
আব্বাস উদ্দিন একাডেমির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বাচ্চু বাংলানিউজকে বলেন, খুলনার গণমানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি খুলনা টেলিভিশন কেন্দ্র। যার সঙ্গে খুলনার সার্বিক উন্নয়ন জড়িত রয়েছে। সুন্দর শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি- সাংবাদিকতা এবং সর্বোপরি শিক্ষা সম্প্রসারণে খুলনার টেলিভিশন কেন্দ্র ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। খুলনায় সমস্ত প্রকার অবকাঠামোগত এবং অন্যান্য সুবিধা থাকার পরেও এটি আজও কেন চালু হয়নি এবং একবার সমস্ত বিষয়টি সম্পূর্ণ করে চূড়ান্তভাবে সম্প্রচারে আসতে আসতে কেন বন্ধ হয়ে গেল তা আজও খুলনাবাসী জানতে পারলো না। যেহেতু অনেকখানি কাজ এগিয়ে রয়েছে তাই এবার প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন অচিরেই খুলনা অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের গতি বহমান রাখতে খুলনার পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্রটি অবিলম্বে চালু করা হোক।
বিটিভির খুলনা উপ-কেন্দ্রের উপ-সহকারী প্রকৌশলী বেগম শাহিনা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, বিটিভির পূর্ণাঙ্গ খুলনা কেন্দ্র চালুর প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়ে আছে।
উল্লেখ্য, খুলনা মহানগরীর খালিশপুরে ৫ দশমিক ৬৬ একর জমিতে দোতলা ভবন নির্মাণ, ৫০০ ফুট উঁচু টাওয়ার ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ১টি ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। ১৯৭৬ সালে এখান থেকে পরীক্ষামূলকভাবে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৭৭ সালের ১১ মার্চ এই উপকেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। ১০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে এই উপকেন্দ্রের সম্প্রচার আওতা হচ্ছে ৮০ অ্যারোনটিক্যাল কিলোমিটার। বর্তমানে এখানে উপ-সহকারী প্রকৌশলী, ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নিরাপত্তা প্রহরীসহ বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০২৩
এমআরএম/এমএম