রাঙামাটি: আজ ঐতিহাসিক ০২ ডিসেম্বর। ২৬ বছর আগে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ে পিসিজেএসএস গেরিলা সশস্ত্র সংগঠন ‘শান্তিবাহিনী’ গড়ে তোলে। সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তৎকালীন সরকার এ সমস্যা নিরসনে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে শান্তিচুক্তি করে। তবে অভিযোগ আছে, চুক্তি পরবর্তী সময়ে পিসিজেএসএসের সশস্ত্র গেরিলা ‘শান্তিবাহিনী’ বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও বাস্তবে তাদের কার্যক্রম পাহাড়ে এখনও বহাল তবিয়ত আছে।
শান্তিচুক্তি পরবর্তী সময়ে চুক্তির বিপক্ষের শক্তি ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। এরপর ধীরে ধীরে পাহাড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সংস্কার, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সংস্কার, মগ লিবারেশন আর্মি বা মগ পার্টি এবং সর্বশেষ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) গড়ে ওঠে।
এক সময় শান্তিবাহিনী চাঁদা আদায় করলেও বর্তমানে চাঁদার হারটা এখন ছয় ভাগে ভাগ হচ্ছে। অর্থাৎ ছয়টি সশস্ত্র গ্রুপকে এখন চাঁদা দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
জানা যায়, এসব সশস্ত্র সংগঠনগুলো বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে।
চুক্তি পরবর্তী সময়ে প্রাপ্তিও কম নয়; দুর্গম পাহাড়ে ঘনকালো মেঘ উবে গিয়ে সূর্যের আলোক রশ্মি পৌঁছে গেছে পাহাড়ের প্রতিটি কানায় কানায়। সব জাতিসত্তার মধ্যে বেড়েছে সম্প্রীতির মিলনমেলা। সরকার এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার স্বাদ দিতে প্রতিষ্ঠা করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ।
দুর্গম পাহাড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আনতে সরকার শতকোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছে সড়ক, সেতু, কালভার্ট। দুর্গম পাহাড়ের অন্ধকার পল্লী বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। যেখানে বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি সেখানে সৌর বিদ্যুতের আলো পুলকিত করছে দুর্গম গ্রাম। স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপক।
চুক্তি পরবর্তী সময়ে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে কৃষিতেও। এক সময় এ অঞ্চলের কৃষকরা সংসারের চাকা ঘুরাতে যেখানে জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, সেখানে উন্নত জাতের শস্য, ফলমূলে পাহাড় সেজেছে নয়ারূপে। সরকার কৃষির উন্নয়নে কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে সার, বীজ এবং কৃষি যন্ত্রপাতি দেওয়ায় কৃষকরা চাষাবাদ করছেন সহজে। কৃষকদের বেড়েছে দ্বিগুণ আয়, জীবন ব্যবস্থায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
রাঙামাটির সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বাংলানিউজকে বলেন, শান্তিচুক্তি হলেও শান্তি ফিরে আসেনি। পাহাড়ে ছয়টি গ্রুপ বিভক্ত হয়ে চাঁদাবাজি করছে। সাধারণ মানুষ এসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি। অস্ত্রধারী সন্ত্রাস বিলুপ্ত না হলে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী নিরুপা দেওয়ান বাংলানিউজকে বলেন, পার্বত্য চুক্তি হয়েছে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু শান্তির দেখা পেলাম না। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাপরিষদগুলোতে নির্বাচন হয় না। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে নির্বাচন হয় না। অনির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করা হয়। চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী বন বিভাগ, পুলিশ বিভাগ হস্তান্তর করা কথা; কিন্তু হস্তান্তর করা হয়নি। চুক্তির ২৬ বছর পার হলেও আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির মুখ দেখেনি।
রাঙামাটি আসনের সংসদ সদস্য, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ দীপংকর তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৮টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। এ চুক্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে, সরকার চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে। এজন্য পাহাড় থেকে আগে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২৩
এসআরএস