ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের সঙ্গে সচেতনতাও বাড়াতে হবে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০২৪
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের সঙ্গে সচেতনতাও বাড়াতে হবে ছবি: রাজীন চৌধুরী

ঢাকা: বর্তমানে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয় তার চেয়ে অধিক ক্ষয়ক্ষতি হয় মানবসৃষ্ট দুর্যোগে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দেশে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে আসবে।

পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। দুর্যোগপরবর্তী উদ্ধারকাজের জন্য অত্যাধুনিক ড্রোনসহ আধুনিক ইকুইপমেন্ট (সরঞ্জাম) ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা গেলে স্মার্ট সোনার বাংলা নির্মাণ সম্ভব হবে।

জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্স হলে এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘দুর্যোগ প্রস্তুতিতে লড়বো স্মার্ট সোনার বাংলা গড়বো’ প্রতিপাদ্যে   এ গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন।  

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম।  বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের পরিচালক ড. মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক আবু তাহের, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ঢাকার পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) যুগ্মসচিব মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, অধিদপ্তরের পরিচালক (ডিজিডি) যুগ্মসচিব মোহাম্মদ বদরুল হক, পরিচালক (মুওপ) যুগ্ম সচিব মো. শাহ আলম প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিজনেস এডিটর রুহুল আমিন রাসেল।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের যুগ্মসচিব ও পরিচালক নাহিদা সুলতানা মল্লিক। এসময় তিনি বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবছর দেশে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতিস্বরূপ ১০ মার্চ জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবসের উদ্দেশ্য হলো মানুষের সচেতনতা বাড়ানো, যাতে সঠিক প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে যেকোনো জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করা যায়।

নাহিদা সুলতানা মল্লিক বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর সপ্তম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বাংলাদেশ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে চলেছে। অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দুর্যোগ ঝুঁকি নিরূপণে আধুনিক বিশ্বের কাছে অন্যতম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসে বাংলাদেশের গৃহীত কার্যক্রমে সবার অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি সারাবিশ্বে এ দেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ‘রোল মডেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশ্বে দুর্যোগ ঝুঁকি তথা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ অবদান রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ কর্তৃক ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।  

দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য তুলে ধরে নাহিদা সুলতানা মল্লিক বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের অবদানগুলোর মধ্যে রয়েছে আপদ পর্যবেক্ষণ ও দুর্যোগের পূর্বাভাস প্রদান, দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা প্রচার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে স্থানীয়করণ, প্রশিক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ, দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ, বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সেতু/কালভার্ট নির্মাণ, জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র নির্মাণ, গ্রামীণ মাটির রাস্তাসমূহ টেকসইকরণে এইচবিবি করণ (২য় পর্যায়), ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগে অনুসন্ধান, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা ও জরুরি যোগাযোগের জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্প (৩য় পর্যায়), বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-সহ নানাবিধ কার্যক্রম।  

প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর সব জায়গায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। যদিও ভূমিকম্পের বিষয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি ঝুঁকিতে আছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের ৫০ লক্ষের বেশি ভলান্টিয়ার প্রস্তুত করা আছে। ইউএনডিআরআর ২০১৫ সালে একটি গবেষণায় বলেছিল দুর্যোগ মোকাবিলায় যদি এক ডলার আগাম বিনিয়োগ করা হয় তাহলে দুর্যোগ পরবর্তীতে ১০ ডলায় সেভ করা সম্ভব হবে। তাই দুর্যোগে আগাম প্রস্তুতি থাকলে আমারা দুর্যোগপরবর্তী সময়ে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারব। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাইকে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। সবাইকে যখন আমরা সচেতন করতে পারব তখনই দুর্যোগের সঠিক প্রস্তুতি নিতে পারব এবং স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারব।  

গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, বাঙালি হচ্ছে লড়াই করা জাতি। আমাদের এমন কোনো অর্জন নেই যেটা লড়াই করা ছাড়া পেয়েছি। দেশে বড় ধরনের দুর্যোগ হলে আমাদের মোকাবিলা করা খুব কঠিন হলেও সরকার যে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েছে তাতে কিছুটা হলেও দুর্যোগ সহজভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তবে আগে আমাদের অবস্থা এমন ছিল না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় পাকিস্তানিরা দুর্যোগের জন্য এদেশে কোনো সহায়তা করতো না। যেজন্য তিনি এ বিষয়ে সেসময় তাদের সঙ্গে অনেক তর্ক-বিতর্ক করেছেন। এর অনেক দিন পরে তারই কন্যা এসে বাংলাদেশের চেহারাটা অনেকটাই পরিবর্তন করেছেন। এর সুফল আমরা চারদিকে দেখতে পাচ্ছি। বর্তমান সময়ে আমাদের চারপাশে যে দুর্যোগগুলো চলছে সেগুলো আরও ভালোভাবে যেন মোকাবিলা করতে পারি সেটাই আমাদের কাজ হওয়া উচিত।  

অনুষ্ঠানে মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী মবিনুর রহমান বলেন, বন্যা ও সাইক্লোনে আমাদের দেশে মৃত্যুর হার ১০ লক্ষ থেকে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আমরা এই দুর্যোগ মোকাবিলায় অনেকাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে নগর জীবনের দুর্যোগের ঝুঁকির ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদি এখনই এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া যায়, তাহলে এই দুর্যোগের ফলে মৃত্যুর হার অন্যান্য দুর্যোগের থেকে বেড়ে যাবে। তাই এখনই এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।  পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টকে যদি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা যায় তাহলে দুর্যোগ মন্ত্রণালয় আরও বেশি শক্তিশালী হবে। আর এমনটা ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও চাচ্ছে।  

দুর্যোগপরবর্তী উদ্ধারকাজের জন্য অত্যাধুনিক ড্রোনসহ আধুনিক ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে আলোচনা সভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ১৫ মিটার পর্যন্ত সেতু কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, উদ্ধারকাজে যদি ড্রোন এবং ফায়ার-প্রুফ ক্যামেরা ব্যবহার করা যায় তাহলে উদ্ধারকাজ অনেকটা সহজ হবে। পাশাপাশি দুর্যোগকালীন ইকুইপমেন্ট ও ডিভাইস আরও বেশি আধুনিক করার প্রয়োজন আছে। একই সঙ্গে এই খাতে বাজেট বাড়ানোরও প্রয়োজন আছে।  

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ঢাকার পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) যুগ্মসচিব মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, বর্তমানে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ আমাদের বেশি ক্ষতি করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায়। এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারলে আমরা এক মাত্রার দুর্যোগ কমিয়ে আনতে পারব। যদি সবার প্রচেষ্টা থাকে তাহলে দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ক্ষতির পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারব।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের পরিচালক ড. মনিরুজ্জামান বলেন, স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কিন্তু ১৯৭০ সালের দুর্যোগের সময় ছিল না। যে কারণে সে সময় মৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনেক স্মার্ট। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা অনেকটা এগিয়ে থাকলেও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে অনেকটাই পিছিয়ে আছি। কারণ এই দুর্যোগে আমরা কোনো পূর্ভাবাস পাই না। পাশাপাশি আমাদের দেশে ন্যাচারাল দুর্যোগের ধরন কিন্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের যেহেতু প্রযুক্তি আছে তাই এখন আমাদের কাজ হবে কমিউনিটিকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করা। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর যে প্রযুক্তি দেশে ব্যবহার হচ্ছে দুর্যোগ মোকাবিলায়, সেখানে সবার অ্যাকসেস থাকতে হবে।  

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্বের, যেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খুব ভালোভাবেই করছেন। তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশের জন্য সেগুলো যুগান্তকারী। আগে নৌদুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি হতো। কিন্তু এক পদ্মাসেতুর কারণে এই নৌদুর্ঘটনায় জীবনহানি একবারে শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সব সংস্থাকে আরও বেশি সমন্বয় করা প্রয়োজন আছে। যেখানে দুর্যোগ অধিদপ্তর লিড রোল পালন করবে। আর এর মাধ্যমে দুর্যোগকে মোকাবিলা করা সম্ভব। কারণ যখন একটি দেশে ভালো করে দুর্যোগ মোকাবিলা না করা যায় তাহলে সেখানে উন্নয়ন সাস্টিনেবিলিটি পাওয়া যায় না। বর্তমানে দেশে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রায় ৫০ লাখের বেশি ভলান্টিয়ার আছে। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে স্মার্ট করতে হলে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে হবে। পাশাপাশি জ্ঞানভিত্তিক চর্চার মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা করা হলে স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৩২ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০২৪
ইএসএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।