ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

অযোগ্য ডিগ্রির তিন ‘অধ্যাপক’ গণস্বাস্থ্যে

অতিথি করেসপন্ডেন্ট, সাভার (ঢাকা) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৬ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২৪
অযোগ্য ডিগ্রির তিন ‘অধ্যাপক’ গণস্বাস্থ্যে

সাভার: বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে অব্যাহতির নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে অবৈধভাবে স্বপদে বহাল ছিলেন তিন সহকার‌ী ‘অধ্যাপক’। কর্তৃপক্ষও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

 

বিএমডিসি বলেছে, ওই তিন অধ্যাপক যে বিভাগে চাকরি করেছেন, তাদের ডিগ্রি সেই পদের জন্য যোগ্য নয়।

যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা হলেন- মঞ্জুর কাদির আহমেদ, একেএম রেজাউল হক ও বরনু বালা। নামের পাশে তারা বড় বড় ডিগ্রি ব্যবহার করেন।

জানা গেছে, ‘ডাক্তার’ মঞ্জুর কাদির আহমেদ বেলজিয়াম থেকে এমপিএইচ (মাস্টার্স অব পাবলিক হেলথ) ডিগ্রি লাভ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ফিজিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। একেএম রেজাউল হক যোগদান করেন গণস্বাস্থ্যের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে। তার নামের পাশে বেলজিয়াম থেকে হেলথ কেয়ার ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি উল্লেখ করা রয়েছে।

আর ডা. বরনু বালা পিএইচডি, ইউএসটিসি ও এফআরসিপি (ডাবলিং) ডিগ্রি দেখিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগ পান মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে। এছাড়া এমসিপিএস ডিগ্রি দেখিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগ নিয়েছিলেন ডা. মেজর (অব) হরবিলতাশ হালদার। বিএমডিসির নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার পরপরই তিনি গণস্বাস্থ্য ছেড়ে চলে যান।

কিন্তু মঞ্জুর, রেজাউল ও বরনু গণস্বাস্থ্যে রয়ে যান। বছরের পর বছর তারা এ সংস্থা থেকে অবৈধভাবে বেতনভাতাসহ নানা সুবিধা ভোগ করেন কোনো যোগ্যতা ছাড়াই। একটি সূত্র জানিয়েছে, একেএম রেজাউল হক এখনও সংস্থাটি থেকে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন।

২০১৫ সাল থেকে বেতন-ভাতাসহ নানা সুবিধা গ্রহণ করেছেন তারা। তাদের মধ্যে একজন আবার তিনটি আলাদা পদ দেখিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পৃথকভাবে বেতন তুলেছেন।

এক অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, বিএমডিসি থেকে মঞ্জুর কাদির আহমেদ, একেএম রেজাউল হক, বরনু বালা মেজর (অব) হরবিলতাশ হালদারকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন শিক্ষক পদায়নের নির্দেশনা দিয়ে দিঠি দেওয়া হয়। বিএমঅ্যান্ডডিসি/১৩-ডি-২০১৫/ স্বারকের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি, মেডিকেল কলেজে অধ্যাপকীয় পদের জন্য ডাক্তার মঞ্জুর কাদির আহমেদ, একেএম রেজাউল হক, ডা. বরনু বালা, ডা. মেজর (অব) হরবিলতাশ হালদারের ডিগ্রি যোগ্য নয়। বিধায় তাদের মেডিকেল কলেজের পদে শিক্ষক হিসাবে বিবেচনা করা যাবে না। তাদের স্থলে নতুন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।

মঞ্জুর কাদির আহমেদের বিরুদ্ধে আবার বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি নিয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্তও হয়েছে। এসব তদন্তের বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন বাংলানিউজের হাতে এসেছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বর্তমান প্রিন্সিপাল (ইনচার্জ) প্রফেসর ডা. মো. ইকবাল হোসাইন স্বাক্ষরিত একটি তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিএমডিসি থেকে অব্যাহতির নির্দেশনা দেওয়ার পর ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অধ্যাপক হিসেবে মঞ্জুর কাদির বেতন উত্তোলন করেছেন। যদিও তিনি ২০১৭ সাল থেকে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রোগ্রামের ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

এছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আইসিইউ স্থাপনের জন্য ৫০ লাখ টাকা অনুদান গ্রহণ করেন মঞ্জুর কাদির আহমেদ। তিনি ও তার আরেক সহযোগী তৎকালীন ডায়ালাইসিস সেন্টারের প্রধান সমন্বয়ক ও সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার মিলে আইসিইউ বাবদ সমস্ত টাকা খরচ দেখান। কিন্তু গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আইসিইউয়ের কোনো কার্যক্রম নেই। আছে শুধু আইসিইউর সাইনবোর্ড দেওয়া একটি কক্ষ। নেই কোনো আইসিইউ স্পেশালিষ্ট। বাংলানিউজে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে খোঁজ নেন অনুদান দাতা নাসরিন বেগম। সংবাদের সত্যতা পেয়ে এ ব্যাপারে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলে বাংলানিউজকে জানান।

এমন নানা দুর্নীতির কারণে গত বছরের ১৮ জুন মঞ্জুর কাদির আহমেদকে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ থেকে সাময়িক অপসারণ করা হয়। তার স্থলে পদায়ন করা হয় ডা. গোলাম রহমান শাহাজাহানকে। এখন পর্যন্ত তিনিই কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, অনেক আগে থেকেই মঞ্জুর কাদির আহমেদ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ৭০ হাজার ৫০০ টাকা বেতন গ্রহণ করতেন। একই সাথে তিনি মেডিকেল কলেজ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদের জন্য ৫০ হাজার টাকা বেতন নিয়েছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রকল্প শুরু হলে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে রোহিঙ্গা প্রকল্পে মাসিক ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বেতনে পদায়ন করা হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকেই কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রকল্পের বেতনের সাথে পূর্বের বেতন ৭০ হাজার ৫০০ টাকা এবং গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ থেকেও মাসিক ৫০ হাজার টাকাসহ প্রতিমাসে ৩ লাখ ৫০০ টাকা বেতন উত্তোলন করেন। যদিও তার আগের বেতন ৭০ হাজার ৫০০ ও মেডিকেল কলেজের ৫০ হাজার টাকা বেতন উত্তোলন করার কথা নয়। তবে মঞ্জুর কাদির আহমেদ একসঙ্গে একই সময়ে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত তিনটি প্রকল্প থেকেই বেতন গ্রহণ করেছেন। যা গর্হিত কাজ ও অন্যায়।

মঞ্জুর কাদির আহমেদের দুর্নীতির অফিস নোটের অতি গোপনীয় একটি নথি এসেছে বাংলানিউজের হাতে। এতে দেখা যায়, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অধ্যাপক আলতাফুন্নেচ্ছা অতিরিক্ত বেতন গ্রহণসহ পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করার আবেদন করেন। এ ব্যাপারে প্রথমে দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত শুরুর আগেই কৌশলে সেই কমিটি স্থগিত করা হয়। পরে মঞ্জুর কাদিরের বিশ্বস্ত দুর্নীতির সহযোগী সম্প্রতি চুরি করে গাছ বিক্রির মামলায় জেলহাজতে থাকা রাজিব মুন্সিসহ তিন সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটির চোখে কোনো ধরনের দুর্নীতি ধরা পড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, মঞ্জুর কাদির আহমেদ কৌশলে প্রথম তদন্ত কমিটি স্থগিত করিয়ে তার দুর্নীতিতে সহযোগিতা করা সদস্যদের দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করান।

এ ব্যাপারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বর্তমান প্রিন্সিপাল (ইনচার্জ) প্রফেসর ডা. মো. ইকবাল হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৫ হাজার, ২০১৫ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত ৩৫ হাজার করে মোট ২ লাখ ৪৫ হাজার, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৯ লাখ ৪০ হাজার এবং ২০২৩ জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪ লাখ ৫০ হাজারসহ মোট ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন মঞ্জুর কাদির। যদিও ২০১৫ সালে বিএমডিসি থেকে তাকে এ পদের জন্য অযোগ্য দাবি করে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া এখন পর্যন্ত কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক একেএম রেজাউল হক অবৈধভাবে বেতন উত্তোলন করে চলেছেন। আমরা একটা একটা করে সমস্যার সমাধান করছি। এ বিষয়টি নিয়েও আমরা সিদ্ধান্তে যাবো।

এ ব্যাপারে কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক একেএম রেজাউল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমি তো জোরজবরদস্তি করে চাকরি করছি না। কর্তৃপক্ষই আমাকে বেতন দিচ্ছে। আমাকে রাখা হয়েছে বলেই আমি আছি। কর্তৃপক্ষ যেতে বললে আমি চলে যাবো।

বিএমডিসির নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি কিন্তু আমাকে নোটিশ করা হয়নি।

অবৈধভাবে শুধু গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ফিজিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে থেকে প্রায় সাড়ে ৩৬ লাখ টাকা বেতন উত্তোলনের ব্যাপারে মঞ্জুর কাদির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি একটি পদ থেকেই বেতন নিয়েছি। ২০১৭ সালের আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। ২০১৭ সাল থেকে আমি কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রকল্পে কাজ করছি।

গণস্বাস্থ্যের চেয়ারপারসন আলতাফুন্নেসা আপনার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তের জন্য ট্রাস্টি বোর্ডকে তদন্তের সুপারিশ করেছেন, এমনকি তদন্তেও আপনার দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। এমন তদন্ত রিপোর্ট বাংলানিউজের হাতে রয়েছে।

এ ব্যাপারে তার ভাষ্য জানতে চাইলে মঞ্জুর বলেন, আমি তো এখনও আলতাফুন্নেসার অধীনেই কাজ করছি। আমি চেয়ারপারসন আলতাফুন্নেসার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। আপনাদের কাছে আমি কোনো বক্তব্য দেব না।

দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চেয়ারপারসন আলতাফুন্নেসার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি তো দেশের বাইরে। আমিই আপনার (সাংবাদিক) সাথে যোগাযোগ করবো। কিন্তু পরে তিনি আর যোগাযোগ করেননি। পরে বাংলানিউজ থেকে তার সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২৪
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।