চাঁপাইনবাবগঞ্জ: স্ত্রী রুনা লাইলা খাতুন নির্বাক হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়। পাশেই ছেলে মসিউর রহমান সাদ ও মেয়ে জান্নাতুন নাইমা বর্ষা অঝোরে কাঁদছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার রাণীহাটি ডিগ্রি কলেজের সামনে গুচ্ছগ্রাম মাঠে হত্যাকাণ্ডের শিকার আব্দুল মতিনের ফতেহপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এমন শোকাবহ দৃশ্য দেখা যায়।
গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাতে গুচ্ছগ্রাম মাঠে সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রাণ হারান নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের মৃত মো. এত্তাজ আলীর ছেলে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের বর্তমান সদস্য ও উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম (৫২)। সেই ঘটনায়ই খুন হন ফতেহপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে ও হরিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মতিন।
হামলায় আহত হন মহারাজপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের এস্তাম আলীর ছেলে আব্দুর রহিম বাদশা ও ফতেহপুর এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে আব্দুস সালাম টিটু।
আব্দুল মতিনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সারা বাড়ি শোকাচ্ছন্ন। তার মা সুফিয়া কামাল আহাজারি করে ছেলের হত্যার বিচার চাইছেন।
আব্দুল মতিনের কলেজপড়ুয়া ছেলে মসিউর রহমান সাদ বলেন, আমার বাবা একজন সৎ শিক্ষক ছিলেন। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকার পরও আব্দুস সালামের কাছে পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে তিনি খুন হয়েছেন। সালামের প্রতিপক্ষ তার ওপর হামলা চালাতে গিয়ে আমার বাবাকেও হত্যা করে।
‘এখন আমাদের কে দেখবে? আমার লেখাপড়ার কী হবে? ছোট্ট বোনটিকে কে আগলে রাখবে?’, বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সাদ।
মতিনের মা সুফিয়া কামাল আহাজারি করে বলছিলেন, ছেলে তার জন্য ওষুধ আনতে গিয়ে আর ফিরলেন না। যারা ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে তাদের ফাঁসি দাবি করেন সুফিয়া কামাল।
তিনি বলেন, ‘কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকার পরও কেন আমার সন্তানকে প্রাণ দিতে হলো। গ্রামে একের পর এক অশান্তি চলছে, অথচ প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই। ’
যেভাবে হত্যাকাণ্ড
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের গুচ্ছগ্রামের ফাঁকা মাঠে আব্দুস সালামসহ কয়েকজন বসেছিলেন। এ সময় তিনদিক থেকে ১৫-২০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল প্রথমে বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং অতর্কিতভাবে তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলাকারীরা সালামকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে এবং পরে কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এসময় পাশে থাকা আব্দুল মতিনকে ধরে মাঠ থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি সরু গলিতে নিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে পালিয়ে যায়।
তাদের বাঁচাতে গিয়ে সালামের দুই সহযোগী বাদশা ও টিটুও গুরুতর আহত হন। সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পর স্থানীয়রা মৃত অবস্থায় সালামকে এবং গুরুতর আহত অবস্থায় অন্য তিনজনকে উদ্ধার করেন। তাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আব্দুল মতিনও।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক মিম ইফতেখার জাহান বলেন, রাত ৯টার দিকে মতিনকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তার মাথা ও পায়ে একাধিক গুলির চিহ্ন ছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হাসপাতালে আনার পথেই তার মৃত্যু হয়। আহতদের শরীরেও গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়।
অন্যদিকে হামলায় গুলিবিদ্ধ টিটুকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
হামলায় আহত রহিম বাদশা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, সন্ধ্যার পরে কলেজ মোড়ে আব্দুস সালামসহ ৪-৫ জন চা পান করছিলেন। এ সময় নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মো. আশরাফ আলীর সমর্থকরা প্রথমে এলোপাতাড়ি বোমা হামলা চালায় এবং পরে গুলি করলে ঘটনাস্থলেই সালাম নিহত হন। তাকে বাঁচাতে তারা এগিয়ে গেলে আব্দুল মতিনসহ তারা দুজন গুলিবিদ্ধ হন। পরে জেলা হাসপাতালে নেওয়ার পথে মতিন মারা যান।
রহিম বাদশার দাবি, আশরাফের ১৫-২০ জন লোক পুকুর পাড় দিয়ে উঠে এসে তাদের ওপর হামলা করে। হামলায় প্রথমে গুলি করে, পরে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এরপর বোমা বিস্ফোরণ করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় তারা।
জানাজা ও দাফন
শুক্রবার সকালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একটি দল ঘটনাস্থলে এসে আলামত সংগ্রহ করে এবং ঘটনাটির ছায়া তদন্তে নামে।
দুপুরে নিহতদের মরদেহ নিজ নিজ পরিবারের কাছে পুলিশ হস্তান্তর করে। পরে তাদের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নামে।
হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী
আব্দুস সালামের স্বজনরা বলছেন, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি নেতা আশরাফের বিপক্ষে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাকুল ইসলাম পিন্টু। তার প্রচারণা ও সহযোগিতায় ছিলেন সালাম। মূলত ওই নির্বাচনসহ এলাকায় আধিপত্য বিরোধের জেরেই সালামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সালামের ভাতিজি রুনা খাতুন অভিযোগ করেন, সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফ আলীর নেতৃত্বে তার চাচা ও সহযোগীদের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এর আগেও দুই দফা তারা হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান। প্রশাসনের তৎপরতা থাকলে হয়তো তার চাচাকে প্রাণ দিতে হতো না।
আব্দুস সালামের চাচি রাহেলা বেগম অভিযোগ করেন, আশরাফ আলীর সন্ত্রাসীরা তার ভাতিজাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এজন্য তিনি আশরাফ আলীর ফাঁসি দাবি করেন।
এখনো গ্রেপ্তার হয়নি কেউ
পুলিশেরও ভাষ্য, মূলত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সালাম গ্রুপ ও আশরাফ গ্রুপের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই বিরোধ চলছিল। রাতে অতর্কিত যে হামলা হয়েছে সেটি আশরাফ গ্রুপের লোকজন চালিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা পুলিশের।
শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো মামলা দায়ের হয়নি। নিহতদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন শেষে শুক্রবার দুপুরে মরদেহ দুটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার ছাইদুল হাসান বলেন, পূর্ব বিরোধের জেরে অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় দুর্বৃত্তরা। চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি চাইনিজ কুড়ালও উদ্ধার করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে।
এক বছরে চার খুন, প্রশাসনের ‘উদাসীনতা’কে দুষছেন স্থানীয়রা
গত এক বছরে নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তারের জেরে সালাম গ্রুপের সালামসহ তিনজন এবং আশরাফ গ্রুপের একজন খুন হয়েছেন।
স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড হলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বারবার ঘটছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করেন তারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুহুল আমিন এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচার দাবি করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০২৪
এইচএ/