ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ পৌষ ১৪৩১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সিলেটের বুঙ্গার চিনি: সিন্ডিকেট ভাঙতেই সিন্ডিকেট!

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৩ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০২৪
সিলেটের বুঙ্গার চিনি: সিন্ডিকেট ভাঙতেই সিন্ডিকেট! আদালতে নিলামের সময় ভিড়, ইনসেটে বুঙ্গার চিনির বস্তা

সিলেট: চোরাই পণ্যকে সিলেটে বলা হয় ‘বুঙ্গার মাল’। আর চোরাই চিনিকে বলা হয় ‘বুঙ্গার চিনি’।

শুল্কফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে চোরাই পথে আসে চিনির চালানই ‘বুঙ্গার চিনি’।  

পুলিশের হাতে আটকের পর চিনির চালান আদালতে নিলামে ওঠে। আর এই চিনির চালান কেজিপ্রতি বাজার দরের চেয়েও অধিক মূল্যে কিনে নেওয়া হয়! 

সিলেটে পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি  চিনি ১০২ টাকা ২০ পয়সা। খুচরা বাজারে বিক্রি হয় কেজি ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়। কিন্তু আদালত থেকে নিলাম করা বুঙ্গার চিনির যেন কদরই আলাদা। নিলামে প্রতিকেজি চিনি ১২৮ থেকে ১৪৫ টাকা চড়া মূল্য দিয়ে কিনে নেওয়া হয়।  

তবে কি ইচ্ছে করে লোকসান গুনতে নিলামে অংশ নিয়ে চিনি কিনছেন ব্যবসায়ীরা! এতো চড়া দাম দিয়ে চিনির চালানে কোটি টাকা বিনিয়োগের নেপথ্যে কোন রহস্য লুকিয়ে?

এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, চিনি নয়, চোরাচালান সিন্ডিকেটের কাছে নিলামের কাগজ বেশি মূল্যবান। এই নিলামের কাগজ চিনি চোরাচালানের সহজ পন্থা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চিনির চালান নিতে আদালত থেকে যে কয়দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়, নিলামের সেই কাগজ নিয়ে এই কয়দিনে কয়েক দফায় চোরাই চিনির চালান আনা যায়। আর আদালতের এই কাগজ দেখিয়ে পার পেয়ে যান চোরাকারবারিরা। তাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে নিলাম প্রতিযোগিতায় প্রভাব বিস্তার করায় চোরাকারবারিরা। আর নিলামের কাগজে পরিমাণ বেশি লেখা থাকলে, সেটি চোরাচালানীদের কাছে বেশি মূল্যবান।

অবশ্য বুধবার (০৩ জুলাই) আদালত থেকে নিলামে ১৪ ট্রাক চিনি কিনে নেওয়া তিন ব্যবসায়ী জানালেন, চোরাকারবারিদের ওই সিন্ডিকেট ভাঙতেই তারা এবার নিলামে অংশ নিয়েছেন। লোকসান হবে জেনেও চিনির চালান কিনেছেন।

১৪ ট্রাক চিনির একটি চালান কিনে নেন নগরের কালিঘাটের চাল ব্যবসায়ী গিয়াস মিয়া। আরেকটি চালানের দরদাতা যুবলীগ নেতা ফয়সল আজাদ খান এবং  অপর চালানটি নেন সুনামগঞ্জের ছাতকের এক চেয়ারম্যানের সহোদর আশফাকুর রহমান চৌধুরী। মূলত: তাদের কারো চিনির ব্যবসা নেই।

বুঙ্গার চিনিতে বিনিয়োগকারী চাল ব্যবসায়ী গিয়াস মিয়া বলেন, এর আগে অনেক নিলাম ডাক হয়েছে। কিন্তু একটি সিন্ডিকেট নিলাম ডেকে নিয়ে যায়। সেই সিন্ডিকেট ভাঙতে ১৪ ট্রাক চিনি নিলামে কিনেছে তার নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট।  এই সিন্ডিকেটে আরো ১৮/১৯ জন রয়েছেন। তিনি ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। অন্যরাও ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা করে বিনিয়োগ করেছেন।  

তবে তার সিন্ডিকেটে কারা এবং প্রতিপক্ষ সিন্ডিকেটে কারা রয়েছেন তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন গিয়াস মিয়া। শুধু জানান, সিন্ডিকেটে ১৯/২০ জন রয়েছেন।  

তিনি আরও বলেন, ১৪ ট্রাক চিনি আদালত থেকে ১২৫ টাকা কেজি দরে কিনেছি। সঙ্গে যুক্ত হবে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট। মোট দাম পড়ে ১৩২ টাকা পঞ্চাশ পয়সা। নিলামকালে আদালতে অগ্রিম দিয়েছি ১০ লাখ টাকা।

বেশি দরে চিনি কেনার বিষয়ে তিনি জানান, বিগত দিনে একটি পক্ষ আদালত থেকে নিলামের বদলে সমঝোতায় চিনি নিয়ে নিতো। আর রাতে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা করে অন্যদের বণ্টন করতো। এই ক্ষোভ থেকে ছোট ভাইদের অনেকে তাকে এসে ধরেন। যে কারণে চাল ব্যবসায়ী হলেও সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য চোরাই চিনির চালান নিলামে কিনতে আগ্রহী হন। এখন সেই চিনি বিক্রি করতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সিন্ডিকেটের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারছেন, এটাই বেশি।

চোরাই চিনির আরেকটি চালান নিলামে নেওয়া যুবলীগ নেতা ফয়সল আজাদ বলেন, আমি সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটসহ ১২৮ টাকা দরে ২ টন চিনি কিনে নিয়েছি। এখন লস দিয়ে বিক্রি করতে হবে। তবে চিনি এখনও আদালতেই আছে। তিন দিনের মধ্যে ছাড়িয়ে আনতে আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন।

তবে চোর ধরতে গিয়ে চোরাই চিনির নিলামে বিনিয়োগের বিষয়ে তার বক্তব্য হলো- প্রত্যেকবার নিলাম ছাড়া চিনি বিক্রি হয়। এই সিন্ডিকেটে যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের পদবিধারীরাও রয়েছেন, এরা কারা? যেহেতু আমি যুবলীগ করি, তাই সর্বোচ্চ ফোরামে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে নিজে চিনির নিলামে অংশ নিয়েছি। আর প্রথম নিলাম ডাকেই পেয়ে যাই।

এ যুবলীগ নেতা অভিযোগ করে বলেন, আমার বাসার পাশেই গোল্ডেন টাওয়ার থেকে চিনির চালান বেরিয়ে যায়। সেখান থেকে প্রশাসন ও কতিপয় সাংবাদিক ভাগ-বাটোয়ারা পেয়ে থাকেন। সেটি আপনারা খোঁজ নিলে জানতে পারবেন।  

নিলামের চিনির কাগজ বিক্রি করতে নয় বরং সঠিক তথ্য বের করতে চিনিতে বিনিয়োগ করেছেন দাবি করেন তিনি।

এতো চড়া দামে চিনি কেনার কারণ জানতে চাইলে আশফাকুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমরা ১০ জন মিলে কিনেছি। বাজার দর হিসাব করিনি। একটু বেশি দিয়ে কিনেছি। এখন বাজার দরেই বিক্রি করতে হবে। তাতে লস হলেও কিছুই করার নেই।

বুধবার (০৩ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৩টায় আদালতে নিলামে ওঠে গত ৬ জুন পুলিশের হাতে আটক ১৪ ট্রাক চিনি। সেই সঙ্গে এয়ারপোর্ট ও দক্ষিণ সুরমা থানা কর্তৃক জব্দকৃত আরো দুটি চালান একই দিনে নিলামে উঠে। ওইদিন বিকাল ৪টার দিকে সিলেট মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতে নিলাম শুরু হয়। নিলাম কমিটির সভাপতি ছিলেন আদালতের বিচারক উম্মে হাবিবা ও ২য় আমলি আদালতের বিচারক সগির আহমদ। তাদের উপস্থিতিতে নিলাম কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে বেলা আড়াইটা থেকে চিনি নিলামের খাতায় এক বা দুই ডজন নয়, নাম লেখান প্রায় ৭০ জন প্রতিযোগী। অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে শত শত নেতাকর্মী ভিড় করেন সিলেটের আদালত পাড়ায়। নিলাম কার্যক্রম দেখতে ভিড় করেন উৎসুক জনতাও।

গত ৬ জুন জালালাবাদ থানা পুলিশ ১৪ ট্রাকে থেকে ২ হাজার ১১৪ বস্তায় এক লাখ ৫ হাজার ৭০০ কেজি ভারতীয় চিনি জব্দ করে। এ ঘটনায় এসএমপির জালালাবাদ থানার মামলায় জব্দকৃত ১৪টি ট্রাক চিনি ছাড়াও এয়ারপোর্ট ও দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ পৃথক অভিযানে আরো দুই ট্রাক চিনি জব্দ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০২৪
এনইউ/এসএএইচ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।