পাথরঘাটা (বরগুনা): ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল (৩০) নামে এক যুবককে আটক করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার এই যুবক বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে।
জানা যায়, ২০১১ সালে তার বাবা, ২০১৩ সালে মা এবং ২০২৩ সালে একমাত্র বড় ভাইও মারা যান। প্রেমসংক্রান্ত বিষয়ে আরও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তোফাজ্জল। পরিবার ও অভিভাবকহীন হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন তিনি। মানসিক ভারসাম্য হারানোর আগে তিনি কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন।
গত বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের গেস্টরুমে তাকে পেটায় একদল শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করা এক নেতাও ছিলেন বলে খবর ছড়িয়েছে। পিটুনিতে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরাই মধ্যরাতে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. ফারুক জানান, শিক্ষার্থীরা রাত ১২টার একটু পরে এই যুবককে হাসপাতালে নিয়ে আসে। এরপর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করলে ওই শিক্ষার্থীদের আর পাওয়া যায়নি। মরদেহটি মর্গে রাখা হয়েছে। বিষয়টি শাহবাগ থানায় জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) হাসপাতালে এসে মো. বেলাল গাজী নামে এক ব্যক্তি তোফাজ্জলকে নিজের বন্ধু পরিচয় দিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।
এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘তোফাজ্জল বরিশাল বিএম কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টটিং বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন তিনি। তবে ৪-৫ বছর আগে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেও থাকতেন। ’
তোফাজ্জলের সঙ্গে একসঙ্গে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসএসসি পাস করেছেন জানিয়ে বেলাল বলে, ‘তোফাজ্জলের বাবা-মা মারা গেছেন বেশ কিছু বছর আগে। এরপর থেকেই তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। একমাত্র ভাই ছিলেন নাসির, পুলিশে চাকরি করতেন। এক বছর আগে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তিনিও মারা যান। একে একে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে আরও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তোফাজ্জল। তারপর থেকেই ঢাবিসহ ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় থাকতেন তিনি। যিনি যা দিতেন সেটাই খেতেন। ’
বেলাল আরও বলেন, ‘এক বছর আগে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে তার ভাইকে দেখতে গিয়ে তোফাজ্জলের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারপর আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। আজকে গ্রামের লোকজন ফেসবুকে তোফাজ্জলের ছবি দেখে আমাকে জানায়। আমি হাসপাতালে এসে আমার বন্ধুর মরদেহ শনাক্ত করি। গ্রামের সবাই জানে পরিবারের একে একে সবাইকে হারিয়ে তোফাজ্জল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ’
তোফাজ্জলের চাচাতো ভাই ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমরা আজ সকালে শুনেছি তোফাজ্জলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এখন ঢাকা মেডিকেলে ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে আছেন চাচাতো ভাই শাহাদাত হোসেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হবেন। মরদেহ আনার পর জানাজা শেষে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তার মরদেহ দাফন করা হবে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘তোফাজ্জলের বাবা আবদুর রহমান মারা গেছেন ২০১১ সালে, মা বিউটি বেগম মারা যান ২০১৩ সালে এবং ভাই পুলিশের এএসআই নাসির উদ্দিন মারা যান ২০২৩ সালে। ’
তোফাজ্জলের চাচা ফজলুল হক বলেন, ‘তোফাজ্জলকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। ’
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান আল ইমরান তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন, ‘তোফাজ্জল আমার জন্মস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সন্তান। তোফাজ্জল পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি। এই ছেলেটি বেশ সজ্জন, পরোপকারী ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন ছাত্রনেতা ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমসংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রথমে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারান। এছাড়া খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তোফাজ্জল তার মা, বাবা ও একমাত্র বড় ভাইকে হারান। তোফাজ্জল পরিবার ও অবিভাবকশূন্য হয়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিন থেকে চার বছর হলো। বিগত দুই থেকে তিন বছর তোফাজ্জল প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতেন। আমাদের এলাকার যারা ওকে চিনতেন সবাই সহযোগিতা করতেন। ক্যাম্পাসে আমাকে দেখলেই দৌড়ে এসে কুশল বিনিময় করতেন। আমি দেখা হলে ওরে খাবার খেতে বলতাম বা খাওয়ার জন্য টাকা দিতাম অথবা ও মাঝেমধ্যে চেয়েও নিতেন। খাবার এবং খাবারের টাকার বাইরে ওর তেমন কোনো চাহিদা ছিল না।
তিনি আরও লেখেন, ‘হয়ত আজকেও খাবারের জন্য তিনি এফএইচ (ফজলুল হক মুসলিম) হলে গিয়েছিলেন। আজকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলের ছোট ভাই সাংবাদিক কবির কাননের ফেসবুক ওয়ালে তোফাজ্জলকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেখি যে তোফাজ্জলকে চোর সন্দেহে এফএইচ হলে আটক করেছে। আমি দেখামাত্রই ফোন করে তোফাজ্জলের বিষয়ে কাননকে অবগত করি যে ও আমার এলাকার ছেলে, আমি ওরে ব্যক্তিগতভাবে জানি, বর্তমানে ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। হয়ত খাবারের সন্ধানে তোফাজ্জল এফএইচ হলে গেছে। আমি কাননকে বলেছিলাম যারা এখন ওরে আটকে রেখেছে তাদের সঙ্গে তুমি কথা বলো, তোফাজ্জল যে মানসিক ভারসাম্যহীন এটা ওদের অবহিত কর, যাতে ওরে শারীরিকভাবে টর্চার না করে। কানন কিছুক্ষণ পরেই আমাকে ফোন দিয়ে জানায় ভাই ওরে আর কেউ টর্চার করবে না, তবে আপনি ওর কোনো অভিভাবককে পাঠান যার কাছে তোফাজ্জলকে দিয়ে দেবে, আমি সেই ব্যবস্থা করতেছি। ’
‘এরপর আমি আমাদের এলাকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি এফএইচ হলে গিয়ে তাকে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকে ম্যানেজ করতে পারিনি। দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ফেসবুকে দেখি তোফাজ্জল এফএইচ হলের শিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতনে মারা গেছে। ’
ইমরান আফসোস প্রকাশ করে লেখেন, ‘আহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! ছাত্র নামধারী বিবেকহীন এই নরপিশাচদের জন্য আজকে একটি নিরপরাধ প্রাণ চলে গেল, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলঙ্কিত হলো। তোফাজ্জলের হত্যার বিচার চাওয়ার মতো ওর পরিবারে অবশিষ্ট আর কেউ নেই। তবে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচার নিশ্চিত করতে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়ে যাব। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪
এজেডএস/আরএ/এইচএ/