ঢাকা: বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, সেটি নিছকই প্রোপাগান্ডা নয় বলে মনে করছেন কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার। তার মতে, ভারতের চালানো এই প্রোপাগান্ডা এক ধরনের সামরিক প্রস্তুতি।
রোববার (৮ ডিসেম্বর) বিকেলে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত হয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের স্বাবলম্বীকরণে সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মতামত ব্যক্ত করেন। বিজিবি সদর দপ্তর পিলখানার সীমান্ত সম্মেলন কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ফরহাদ মজহার বলেন, আমি মনে করি না আজকে ভারত যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, এটা নিছকই প্রোপাগান্ডা। এটা এক ধরনের সামরিক প্রস্তুতি। আপনারা দেখেছেন, মব চলে আসছে সীমান্তে। দলবেঁধে তারা সীমান্ত অতিক্রম করবে, এত বড় দুঃসাহস দেখাচ্ছে ভারত। আমরা তো চাই, এটিকে আমাদের সরকারে যারা আছেন, তারা আমলে নেবেন, যাতে কোনোভাবেই ভারত অভ্যন্তরীণভাবে আমাদের বিশৃঙ্খল করতে না পারে, জনগণের ঐক্য ভাঙতে না পারে।
বিজিবির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রোপাগান্ডার দ্বারা প্রভাবিত হবেন না। দেশের মধ্যে জনগণ বনাম সৈনিক যে দ্বন্দ্ব, এই দ্বন্দ্ব ৫ আগস্ট আমরা অতীতে ফেলে এসেছি। এখন একজন সৈনিক যেমন নাগরিক, তেমনি একজন নাগরিকও সৈনিক। যদি তা হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের দ্রুত বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা দরকার। আজকে ভারতের যে আস্ফালন, সেই আস্ফালনের উপযুক্ত উত্তর দেবার জন্য অবিলম্বে আমাদের প্রতিটি নাগরিককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। আমরা খুবই বিপদের মধ্যে রয়েছি।
ফরহাদ মজহার আরও বলেন, শেখ হাসিনা আসলেই ভারতের দালালস্থানীয় ছিল। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ ১৫ বছর যুদ্ধ করেছে। আমরা সেই যুদ্ধ সহ্য করেছি। আমরা যখন জয়ী হয়েছি, এখন তারা আছে ভারতে। যারা বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাদের এই ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান আশা করি, দিল্লি আজকে হোক, কালকে হোক, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার পরিকল্পনা নিয়েই এদেরকে ভারতে জায়গা দিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ রয়েছে। এটা জানার পরে আপনারা (সরকার) কেন আমাদের সৈনিকদের তৈরি করছেন না? কেন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি না? অনেক আগে থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্স হিসেবে প্রথম শত্রুর বুলেট মোকাবিলা করবে বিজিবি। ফলে তাদের অবশ্যই আমাদের জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্গত হতে হবে। তাদের কাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে পুলিশের অভাবে বাহিনীটির ভূমিকা পালন করা নয়। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র এই কাজ করে না। পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্র সৈনিকদের এভাবে অপব্যবহার করে না।
ফরহাদ মজহার বলেন, আজকে যারা নাগরিক ও মানবাধিকারের কথা বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে র্যাবকে বিলুপ্তির কথা বলেছেন। প্রথম যখন র্যাব গঠিত হয়, তখন আমি একটি লেখায় বলেছিলাম, এই র্যাবের কারণে বিএনপির পতন ঘটবে, আজকে বা কালকে। কেন এই ঘটনাটা ঘটছে? কারণ, আপনি সেনাবাহিনীর একজন সদস্যকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনে এমন কিছু কাজ করাচ্ছেন, যেটা সৈনিক কখনো করে না। নিরস্ত্র মানুষকে বিচারবহির্ভূত হত্যা সেনাবাহিনী কখনো করে না। সৈনিক সব সময় আরেকজন অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে, কখনো নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে সে বন্দুক ধরে না। এটা আমরা আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকিয়েছি।
র্যাবকে বিলুপ্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানান ফরহাদ মজহার। পাশাপাশি অতি দ্রুত বিজিবিকে ফার্স্ট লাইনার ডিফেন্স আকারে গড়ে তোলার আহ্বান করে তিনি বলেন, বিজিবি আমাদের সৈনিক, তারাই আমাদের রক্ষা করবে। সৈনিকের মর্যাদা যে জাতি বুঝতে পারে না, কথায় কথায় সৈনিককে নিন্দা করে, সেই জাতি কখনো বড় কিছু হতে পারবে না। কারণ সৈনিকতা অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, আমি ইতিহাসের একজন দ্রষ্টা হিসেবে বলছি, আমাদের কতগুলো জাতিগত বিভ্রান্তি আছে। এই বিভ্রান্তি খুব দ্রুত আমাদের কাটাতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে বিশ্ব খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আজকে পৃথিবীর সমস্ত ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস বদলাচ্ছে। একইসঙ্গে উপমহাদেশের বিন্যাস বদলাচ্ছে। আজকে চীন আমাদের চোখের সামনে এত বড় শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। ১৯৭৬ সালে এই চীন আর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা একই ছিল। তাহলে চীন পারল, আমরা কেন পারছি না। কোথায় সমস্যা আমাদের? আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্র, সরকার, সৈনিক, নাগরিক কাকে বলে এই বিষয়ে আমাদের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট। যে কারণে আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনার আমলে সব সময় জনগণকে সৈনিকদের বিরুদ্ধে এবং সৈনিকদের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো। আজকে আমাদের সবার প্রতিশ্রুতি নেওয়া দরকার, এই পুরোনো পদ্ধতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যেখানে ফ্যাসিস্ট শক্তি সৈনিকদের ব্যবহার করে ধনী, লুটেরা, মাফিয়াদের পাহাদার হিসেবে। সৈনিকরা জনগণের পাহারাদার, জনগণকে বুঝতে হবে, সৈনিকরা তাদেরই ভাই, সন্তান। এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে যদি আমরা দ্রুত দাঁড়াতে না পারি, তাহলে সামনে আমাদের জন্য অনেক বড় বিপদ ধেয়ে আসছে। এই বিপদটা আমাদের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সবার আগে বুঝবে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড।
ফরহাদ মজহার আরও বলেন, আজ আপনারা (বিজিবি) দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সৈনিকের যে সম্পর্ক তৈরি করেছেন, সেটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষায় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই ঘটনাটা তাৎপর্যপূণ, কারণ আমরা ইতোমধ্যে একটি বিপ্লব করেছি, যেটাকে আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থান বলছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা একটি গণঅভ্যুত্থান করেছি, জনগণ জেগেছে। আর জনগণ জাগার মনে হলো, দেশকে রক্ষার ক্ষেত্রে যিনি সৈনিক তিনি নাগরিক; যিনি নাগরিক, তিনিই কিন্তু সৈনিক।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিতি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। আরও উপস্থিতি ছিলেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, মেজর (অব.) ফেরদৌস, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ৪ জন আহতকে স্বাবলম্বীকরণে এক লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয় এবং দুজনকে দুটি অটোরিকশা ও একজনকে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২৪
এসসি/এমজেএফ