ইতিহাস সাক্ষী, স্বৈরশাসকদের পরিণতি কখনোই শুভ হয় না। জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।
আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় নতুন করে স্বৈরতন্ত্রের সূচনাকারী অ্যাডলফ হিটলারকে বলা হয়। যার মতো করে স্বৈরতন্ত্রে এখন চলছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে।
সম্প্রতি কয়েকটি দেশে স্বৈরশাসনের পতনের পর বিশ্বব্যাপী নতুন করে আলোচনা চলছে- শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, সিরিয়ার পর কোন দেশ এমন ঘটনার সাক্ষী হবে?
রোববার (৮ ডিসেম্বর) স্বৈরশাসন পতনের এক ইতিহাসের সাক্ষী হলো বিশ্ব। বিদ্রোহীদের তোপের মুখে সিরিয়া ছেড়ে পালান দেশটির ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। দুই যুগ ধরে সিরিয়া শাসন করেছেন তিনি।
বিশ্ব একইরকম ঘটনার সাক্ষী হয়েছে গত ৫ আগস্টে। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গণভবন ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৫ বছরের ক্ষমতার ইতি টানতে হয় হাসিনার দল আওয়ামী লীগ সরকারের। গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরশাসন ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছিল হাসিনা সরকার।
২০২২ সালেও জনতার হাতে এক শাসকের পতন দেখেছে বিশ্ব। সে বছর অর্থনৈতিক সংকট ও জনগণের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। মালদ্বীপ হয়ে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান তিনি।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন বলছে,সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতৃত্বেই সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন ঘটে। এইচটিএসর প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। তার নেতৃত্বে এইচটিএস শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
গত ৮ ডিসেম্বর এইচটিএসের পক্ষ থেকে বলা হয়, জালিম শাসক বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সিরিয়া এখন মুক্ত। এর মধ্য দিয়ে একটি অন্ধকার যুগের সমাপ্তি শেষে একটি নতুন যুগের সূচনা হলো।
পরে জানা যায়, পালিয়ে রাশিয়ার মস্কোয় আশ্রয় নিয়েছেন আসাদ। সিরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দামেস্কের দখল নিলে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে পালিয়ে যান তিনি। অবসান ঘটে তার ২৪ বছর শাসনের।
এর আগে বাংলাদেশে গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ৬১ দিনের ঘটনাপ্রবাহে ঝরেছে দুই হাজারের কাছাকাছি প্রাণ, আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন অনেকে।
১ জুলাইয়ে শুরু হয় চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন, যা দেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রাজাকার’ বলায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ তীব্রতর হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগসহ সরকার সমর্থকরা। যা আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে।
এরপর টানা ২০ দিন আন্দোলনে বহু শহীদের আত্মাহুতির মাধ্যমে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
পরের আলোচনায় কোন কোন দেশ
তীব্র আন্দোলনের মুখে এ ধরনের পালানোর ঘটনা কি সামনে আরও দেখা বাকি? - সে প্রশ্ন জেগেছে এখন। কোন কোন দেশে এমনটিই ঘটতে পারে প্রশ্নে প্রথমেই যে দেশের নাম প্রথমে আসে তাহলো উত্তর কোরিয়া। কিম জং উনের একনায়কতন্ত্র চলছে দেশটিতে। শাসক পরিবারের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের বিরোধিতা কঠোর হাতে দমন করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে।
এই তালিকায় রয়েছে সবচেয়ে বৃহৎ দেশ রাশিয়া। ভ্লাদিমির পুতিন দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন। দেশটির শাসনব্যবস্থা অনেকটা স্বৈরতান্ত্রিক রূপ নিয়েছে বলে খবর। বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আসছে রাশিয়া।
স্বৈরশাসনের তালিকায় রয়েছে রাশিয়ার মিত্র দেশ বেলারুশ। দেশটির শাসক আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো। নির্বাচনে কারচুপি এবং বিরোধীদের দমন করার কারণে তার সরকার স্বৈরাচারী বলে বিবেচিত করা হয়। ‘ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক’ তকমা পেয়ে গেছেন অনেক আগেই তিনি।
স্বৈরশাসক স্বীকার করলেও নিজেকে ইউরোপের একমাত্র স্বৈরশাসক ভাবতে রাজি নন লুকাশেঙ্কো। গত বছর এক আলোচনা সাপেক্ষে আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো বলেছিলেন, ‘আমি স্বৈরশাসক যদি হইও, তবে ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক নই। ’
এদিকে নাজুক অবস্থা বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। স্বৈরশাসনের আঁতুড়ঘর বলা হয় দেশটিকে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। তখন থেকেই একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে সেখানে। দেশটির রাখাইনে সামরিক বাহিনীর নির্মম ও বর্বর রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এখনও থামেনি। এক কথায় স্বৈরশাসনের আলোচনার মধ্যে রয়েছে দেশটি।
আলোচনায় থাকা ভেনেজুয়েলা দেশটিও গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে গেছে বলে ধারণা করা হয়। দেশটির শাসক নিকোলাস মাদুরের বিরুদ্ধে বিরোধীদের দমন, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত করার অভিযোগ রয়েছে।
মিয়ানমারের কাছের দেশ কম্বোডিয়াও রয়েছে স্বৈরশাসনের তালিকায়। কয়েক দশক ধরে দেশটির শাসনকার্য চালিয়ে আসছিলেন হুন সেন। দেশটির শাসনব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক বলা হয়। তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, দেশটি কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অধীনে রয়েছে।
কারণ, প্রায় চার দশক পর ক্ষমতা ‘হস্তান্তর’ ঘটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে। তবে ক্ষমতার এই হাতবদল হয় দেশটির প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের ছেলে সেনাপ্রধান হুন মানেতের কাছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০২৪
এসএএইচ