ঢাকা: দেশের চলমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে না পারলে সংস্কারের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হবে না বলে মন্তব্য করেছেন লেখক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেছেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হলে মার্কেট সিস্টেমের অবিচার দূর করতে হবে।
মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় গুলশানের অটোবি সেন্টারের সেলিব্রিটি কনভেনশন হলে জাতীয় নাগরিক কমিটি ঢাকা মহানগর উত্তর আয়োজিত ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের’ লক্ষ্যে থানা প্রতিনিধি সভায় অতিথি আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই জুলাই আগস্টের গণহত্যার ওপর প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরা হয়। সেখানে কোটা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ অবদি প্রতিদিনের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়।
৭২ সংবিধান বর্তমানে ঘুমিয়ে পড়েছে এবং কেন ফ্যাসিবাদী হয়েছে তা উল্লেখ করে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, আমরা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার আগে সংবিধান লিখিনি। মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার পর আমরা সংবিধান লেখার দায়িত্ব বা ক্ষমতা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আমরা অপব্যবহার করেছি। ৭২ সালে যে সংবিধান লেখা হয়েছিল, বর্তমানে সেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। এর যে সমস্যাটা আছে সেটা একটা স্কুলের বাচ্চাও বুঝতে পারবে। ৭২ এর এই সংবিধানের দুটি ভাগ। একটি হচ্ছে জনগণের অধিকার যা প্রস্তাবনা আকারে আছে। এবং অন্যটি হচ্ছে আমলাতন্ত্রের শাসন যার নাম দেওয়া হয়েছে নির্বাহী বিভাগ। সেখানে প্রধান আমলা হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি। ৭২ সালের আমাদের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার নামে যে ভাগ করা হয়েছে তা আইনে বলবৎ যোগ্য নয়।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, দেশে যদি রাজনৈতিক ভিত্তিতে চলে তাহলে রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন আছে। বর্তমান বিদ্যমান রাজনৈতিক দল যারা আছেন তাদের মধ্যে এক প্রকার সংশয় কাজ করছে, যে তরুণরা কি করবেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, দেশে যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র চান তাহলে বহু রাজনৈতিক দল থাকার প্রয়োজন আছে। কারণ, ক্ষমতায় থাকা দল যদি কোনো খারাপ কিছু করে তাহলে তার সমালোচনার জন্য এইসব প্রয়োজন। ড. কামাল হোসেনরা ৭২ এ যে সংবিধান দিয়েছিলেন সেখানে বলা ছিল সার্বভৌমত্ব হচ্ছে সংসদের, এটা ভুল কথা। সার্বভৌমত্বের সহজ বাংলা হচ্ছে মালিকানা। আমরা বলছি সমস্ত ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ। এই জনগণই ক্ষমতার কেন্দ্র। আর উৎস বলতে বোঝায় ক্ষমতা। আপনি ক্ষমতা কাকে চালানোর জন্য দিলেন। এখানে বুঝতে হবে কোন ক্ষমতা। আপনি মালিকানা কাউকে দেন না। আপনি ম্যানেজারি করার ক্ষমতা দেন। আর রাষ্ট্রে যারা সংসদে নির্বাচিত হন তারা হচ্ছে বড়জোর ম্যানেজার। দেশের জনগণ অর্থাৎ মালিকরা তাদের নিয়োগ দেন এবং তারা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তাহলে মালিকের অধিকার আছে তাদের চাকরি থেকে বহিষ্কার করার। আর এটাই হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্ব।
তিনি বলেন, সার্বভৌমত্ব কখনো এক বা দুই ব্যক্তির হয় না। বাংলাদেশের সমস্ত ১৮ কোটি জনগণ মিলেই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। আর আমরা সার্বভৌমত্ব এতদিন এক ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এটা হচ্ছে আমাদের ঐতিহাসিক ভুল বা ব্যর্থতা। সার্বভৌমত্ব কিন্তু একজনের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। সংবিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে জনগণের কাজ।
জুলাইয়ের ঘোষণা পত্রের বিষয়ে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন৷ এখন বলা হচ্ছে তারা একটি ঘোষণাপত্র দিতে পারবেন কি না। এখানে ঘোষণা পত্র হচ্ছে, যে কাজ করেছি তার রিপোর্ট পেশ করা। এখানে অনেকে মনে করছে ঘোষণা করে বিপ্লব হবে। কিন্তু অনেকে বিপ্লব করে ঘোষণা করে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সভায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল রুট লেভেল থেকে করা হয় নাই। তবে নাগরিক কমিটি যে অল্প সময়ে এই সংগঠন করল তা রুট লেভেলের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংগঠন তৈরি করেছে। এই কমিটির কাজ হচ্ছে পাড়া মহল্লায় অর্থাৎ রুট লেভেলের মানুষের কাছে যাবে। রুট লেভেলে নাগরিক কমিটি কাজ করতে গিয়ে দেখেছে এদেশে মানুষ ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্বাস করে না। এবং বর্তমান সরকারের প্রতিও আস্থা নেই। মোট কথা বাংলাদেশে এতদিন যে রাজনৈতিক বন্দবস্ত আছে তা মোটেও ভালো না। এই বন্দবস্ত দূর করতে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সভায়, নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেমন হওয়া প্রয়োজন জানিয়ে নাগরিক কমিটির সদস্য এহতেশামুল হক বলেন, আমাদের আগে ক্ষমতা ও দায়িত্ব এই দুটি বিষয় সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। বাংলাদেশে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। সবাই ছোটে ক্ষমতার পেছনে। যে কারণে স্টেজ ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে। এগুলো থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নিজেদের অ্যাবিলিটি বাড়াতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। এদেশে জনগণের কাতারে দাঁড়িয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী প্রয়োজন। বিএনপির ৩১ দফার মতো নয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ২২৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৫
ইএসএস/এমজে