মাদারীপুর: ইতালি যেতে পারলে পরিবারে সচ্ছলতা আসবে। দূর হবে দুঃখ-কষ্ট।
রঙিন স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নেয় লিবিয়ার গেমঘরে! দালাল বা মাফিয়াদের হাতে বন্দি থেকে!
সম্প্রতি রাকিব মহাজন নামে এক তরুণ দালালদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন। অথচ তাকে মুক্তি দিতে পরিবারের কাছ থেকে দালালচক্র হাতিয়ে নিয়েছে ৪২ লাখ টাকা! এখন ছেলের লাশ চান তারা বাবা-মা। শেষ বার একটু ছুঁয়ে দেখতে চান সন্তানকে!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উন্নত জীবনের আসায় ইতালিতে পাড়ি জমাতে গিয়ে টানা তিন মাস লিবিয়ার বন্দিশালায় অমানুষিক নির্যাতনের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মাদারীপুরের রাকিব মহাজন! অথচ তার মুক্তির জন্য মাফিয়াদের দফায় দফায় ৪২ লাখ টাকা দিয়েছে রাকিবের পরিবার। রাকিবের মৃত্যুর খবর আসার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন পরিবার। দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানায়, 'তিন বছর আগে উন্নত জীবনের আশায় বাড়ি ছাড়ে মাদারীপুর সদর উপজেলার পখিরা গ্রামের নাজিম উদ্দিন মহাজনের ছেলে রাকিব মহাজন। এরপর ধরা পড়ে লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে। সেখানেই রাকিবকে বন্দি করে চালানো হয় নির্যাতন। পরিবার কয়েক দফা মুক্তিপণের টাকা দিলেও মুক্তি মেলেনি রাকিবের। '
স্বজনরা জানায়, স্থানীয় দালাল জাহাঙ্গীর মৃধার প্রলোভনে পড়ে রাকিব। পরে জাহাঙ্গীরের ভায়রা সোহাগ মাতুব্বরের মাধ্যমে ২৭ লাখ টাকায় ইতালী পাঠানোর চুক্তি হয়। সমুদ্রপথে লিবিয়া হয়ে ইতালী যাওয়ার সময় লিবিয়ার দালালরা বন্দিশালায় জিম্মি করে রাকিবকে। এরপর আদায় করে মুক্তিপণের টাকা। শেষে রাকিবকে বিক্রি করে দেওয়া হয় লিবিয়ায় বসবাসরত মাদারীপুরের ঝাউদির গ্রামের আরেক দালাল মাজেদ ফলিকার কাছে। সেও একই পদ্ধতিতে পরিবার থেকে আদায় করে আরও ১৫ লাখ টাকা। এরপর রাকিবকে খাবার দেওয়া বন্ধ করে দেয় দালালরা। পরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে লিবিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে রাকিবকে রেখে পালিয়ে যায় মাফিয়ারা। গত বুধবার (২২ জানুয়ারি) বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে মৃত্যু হয় রাকিবের। '
নাজিম উদ্দিন মহাজন বলেন, 'এক দালালের মাধ্যমে প্রথমে চুক্তি হয়। পরে লিবিয়ায় পৌঁছালে আবারো বিক্রি করে দেয় আমার ছেলেকে। পরে অন্য দালাল বন্দিশালায় জিম্মি করে নির্যাতন করে আদায় করে লাখ লাখ টাকা। রাকিবের মৃত্যুর খবর আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমার ছেলের মরদেহটি একনজর দেখতে চাই। এখন সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কোনো অবস্থায় আমরা ফিরে দাঁড়াতে পারবো না। '
স্থানীয় কয়েকজন জানান, এই দালালদের হাত বড় শক্তিশালী। এলাকার মানুষও দালালদের ভয়ে কিছু বলতে পারে না। তাদের কঠোর বিচার না হলে কিছুতেই এমন মৃত্যু থামবে না। ৪২ লাখ টাকা নিয়েও রাকিবের মুক্তি মিলল না। প্রায় আড়াই বছর রাকিবের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। পরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রাকিব। আমরা এলাকাবাসী এমন দালালদের কঠোর শাস্তি চাই। '
রাকিবের মা হাসিয়া বেগম বলেন, আমাদের কাছ থেকে প্রথমে ২৭ লাখ টাকা নিয়েছে। তারপরও আমার সন্তান রাকিবকে ইতালী পাঠায়নি। পরে দালালদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে আরও ১৫ লাখ টাকা আদায় করে চক্রটি। দালালদের নির্যাতনে আমার ছেলে মারা গেছে, এই ঘটনার বিচার চাই। '
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা বলেন, 'নিহত রাকিবের পরিবার থেকে লিখিত অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাদারীপুর থেকে ইতালীসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রবনতা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর অবৈভভাবে ইতালী যাবার পথে মারা যায় মাদারীপুরের অনেকে মানুষ। জেলার বাসিন্দারা সচেতন না হলে কোনোভাবেই এই মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না। এছাড়া এই দালালদের বিরুদ্ধে মামলা হলে আসামি গ্রেপ্তার হয়, তারপর বাদী ও আসামিপক্ষ আপোস হয়ে যায়। এ কারণেও এই প্রবনতা কমছে না। '
মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ্ মোহাম্মদ সজীব বলেন, 'রাকিবের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। সেক্ষেত্রে নিহতের পরিবার থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত দিতে হবে। পরে দূতাবাসের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেবে প্রশাসন। '
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৫
আরএ