ময়মনসিংহ: ২০১৩ সালের জানুয়ারি। ময়মনসিংহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা।
বিভাগ না সিটি কর্পোরেশন, এ ইস্যুতে শুরু হয়ে যায় ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের স্নায়ুযুদ্ধ। এরপর সিটি কর্পোরেশন ইস্যুতে এক পক্ষের নেতা-কর্মীরা আনন্দ মিছিল করে জানান দেয় নিজেদের বিজয় বার্তা! এরপর মিইয়ে যায় এ বিষয়ক আলোচনা।
দু’বছরের বিরতিতে আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে ময়মনসিংহ বিভাগ। রাজনীতি সচেতন, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ হয়েও কাঙ্খিত উন্নয়নের দিশা না পাওয়া ময়মনসিংহবাসীকে উৎসবের অনন্য এক উপলক্ষ এনে দেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সিদ্ধান্ত নেন ময়মনসিংহ বিভাগের।
দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এমন ঘোষণায় হয়ে উঠে আবেগ উদ্দীপ্ত। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সেই আবেগের নব দিগন্ত।
তিন দশক পর প্রাণের দাবি পূরণের সিদ্ধান্তের পর এবার শুরু হয়েছে নতুন রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে ময়মনসিংহ বিভাগের সিদ্ধান্তের কৃতিত্ব কার এ নিয়েই মূলত রশি টানাটানি। একদিকে ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানকে বিভাগ ঘোষণা আদায়ে সংবর্ধনা দিয়েছে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা।
আবার জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা প্রচার করছেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ এমপি’র ভূমিকার কারণেই প্রধানমন্ত্রী ময়মনসিংহ বিভাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর নাগরিক নেতাদের দাবি, ময়মনসিংহ বিভাগ তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। অবশ্য সবাই একবাক্যে এ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে।
রওশনের কারণেই ময়মনসিংহ বিভাগ
বিরোধী দলীয় নেত্রী ও ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য বিরোধী দলীয় নেত্রীর বিভাগ দাবিতে অনড় অবস্থানের কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহ বিভাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এমন দাবি জেলা জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের।
তাদের ভাষ্য হচ্ছে- দশম সংসদে বেগম রওশন এরশাদ কমপক্ষে ৩ বার বিভাগের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। ময়মনসিংহের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেছেন অচিরেই ময়মনসিংহ বিভাগ বাস্তবায়নের।
সর্বশেষ গত বছরের ১১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত ও বিজয় দিবসের মঞ্চে ম্যাডাম বলেছিলেন, ‘ময়মনসিংহ বিভাগ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। শিগগির প্রধানমন্ত্রীকে ময়মনসিংহে এনে বিভাগ ঘোষণা করা হবে। ’
জেলা জাতীয় পার্টির এক নেতা বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই ময়মনসিংহ বিভাগের পক্ষে নিজের সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছিলেন রওশন এরশাদ। তিনি কখনোই ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের দাবি তোলেননি। এখন রাজনৈতিক ক্রেডিট নিতে অনেকেই ভোল পাল্টাতে পারেন।
জানতে চাইলে জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আহমেদ বলেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে রওশন এরশাদ ময়মনসিংহ বিভাগের জন্য ব্যাপকভাবে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এরই ফলস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী ময়মনসিংহ বিভাগের তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য বঙ্গবন্ধু কন্যাকে অভিনন্দন।
কৃতিত্ব ধর্মমন্ত্রীর, অত:পর সংবর্ধনা
‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ময়মনসিংহ বিভাগ বাস্তবায়নের ঘোষণা আদায় করার জন্য ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানকে গণসংবর্ধনা’ গত বৃহস্পতিবার শহরের রেলওয়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে আ’লীগের একটি অনুষ্ঠানের ব্যানারে ছিলো এমন তথ্য। সেই অনুষ্ঠানের সব বক্তাই এ দীর্ঘ সময়ের এ দাবি পূরণে কৃতিত্ব দেন ধর্মমন্ত্রীকে। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রতি।
পিছিয়ে নেই নাগরিক আন্দোলন বা অন্যরাও
প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে ময়মনসিংহ বিভাগের সিদ্ধান্তের পর ওইদিন সন্ধ্যায় শহরে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করে ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলন। বিভাগের কৃতিত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী নুরুল আমিন কালাম বলেন, ‘ময়মনসিংহ বিভাগের জন্য আমরা কী করেছি, তা এ অঞ্চলের মানুষই বিচার করবে।
এ দাবিতে গত ২৫ বছরে আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচির দলিল আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। অথচ এ দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলন করতে একটি প্রভাবশালী মহল আমাদের বাধাও দিয়েছিল। ঘেরাও উপেক্ষা করেই সেদিন আমরা সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম ময়মনসিংহ বিভাগ দাবিতে। এখন তারা হয়তো সুর বদলেছেন। ’
ময়মনসিংহ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সংগঠন ‘জেগে উঠো ময়মনসিংহ’র ব্যানারে এ দাবিতে আন্দোলন করা তরুণ ব্লগার জামান পায়েল বলেন, ‘নগর নয়, মহানগরের বাসিন্দাই আমরা হতে চেয়েছিলাম। এ কারণে বিভাগের দাবিতে অনলাইনে আমরা আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলাম। মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছিল ‘নো ডিভিশন নো ভোট’ শ্লোগান।
বিভাগের মোড়কে প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা
ময়মনসিংহ বিভাগ ইস্যুতে হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের তরুণ এক নেতা কয়েক লক্ষ টাকা খরচা করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে হাইকমান্ডের দৃষ্টির পাশাপাশি প্রচারণার আলোতে আসার চেষ্টা করেছেন। অভিনন্দন বিজ্ঞাপনের একেবারে শেষে নিজের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামজুড়ে দেয়ায় সৃষ্টি হয় এমন আলোচনা-সমালোচনা। এ নেতার প্রচারণার দিককে বিরোধীরা অভিহিত করেছেন, ‘বিভাগের মোড়কে প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা’।
‘এখন অনেকেই অনেক কথা বলবে’
ময়মনসিংহ বিভাগ নিয়ে রাজনীতির বিষয়ে টানা দু’দিন মুঠোফোনে চেষ্টার পর সাড়া না দিলেও তৃতীয় দিনের মাথায় শনিবার রাতে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ এমপি।
আওয়ামীলীগের এক পক্ষের কৃতিত্বের দাবির বিষয়ে প্রশ্ন করলে সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলেন, ‘এখন অনেকেই অনেক কথা বলবে। বললে তো আর কারো মুখ ধরে রাখা যায় না। বিভাগ হয়েছে এটা ময়মনসিংহের সবার জন্যই ভালো। অভিন্দন প্রধানমন্ত্রীকে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৫