ঢাকা: উচ্চ আদালতে মামলার জট কমানোসহ স্বাধীন বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আশায় বুক ভরালেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা)।
রোববার (১৮ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক নম্বর আদালত কক্ষে সংবর্ধনা শেষে এক বক্তব্যে তিনি এ আশার বাণী শোনান।
উচ্চ আদালতে মামলার জট কমানো, ছুটি কমানো, অধ:স্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ, সিনিয়র বিচারপতিদের গুরুত্ব দিয়ে বেঞ্চ গঠনসহ বেশকিছু পদক্ষেপের কথা জানান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
এছাড়াও সকল ধরনের সন্ত্রাস দমনে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, আমরা জানি, অধিকাংশ সময় উন্মত্ত সন্ত্রাসী কার্যক্রমের শিকার হয় নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ। সকল ধরনের সন্ত্রাস দমনে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাসবাদ দমন কখনো সম্ভব হবে না, যদি কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে নিন্দা, আবার অন্য কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে যদি সহ্য করা হয় এবং বৈধতা দেওয়া হয়। সত্যিকারের অপরাধীদের ন্যূনতম সময়ে শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা না করা গেলে সন্ত্রাস দমন করা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
নতুন এ প্রধান বিচারপতি বলেন, সম্প্রতি কিছু স্পর্শকাতর মামলায় এটা আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও উপকরণের অভাবে দণ্ডিতের দণ্ড বহাল রাখা যাচ্ছে না। যেগুলো তদন্ত পর্যায়ে সংগ্রহ করার কথা ছিলো। প্রমাণ সংগ্রহের পরিবর্তে ফৌজদারি তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে পত্রিকায় খবর প্রকাশের অধিক প্রবণতা আমি লক্ষ্য করেছি। এটা অধিকাংশ মামলার বিচারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
তিনি বলেন, উপযুক্ত আদালতে একটি স্বচ্ছ বিচারের আগে আইনগতভাবে কাউকে অপরাধী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় না। তাই প্রচার এড়িয়ে পেশাদার হতে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন আনতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সব সদস্যের প্রতি আহবান জানান প্রধান বিচারপতি।
সংবর্ধনায় এস কে সিনহার নিয়োগকে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের জন্য বিরাট অর্জন উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আপনার নিয়োগে আজ সংবিধানের একটি মুলস্তম্ভ অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতার বাস্তব প্রতিফলন ঘটলো। বর্তমান বিশ্বে সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতাও বিবেচিত হয়।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে মাহবুবে আলম বলেন, বর্তমানে বিচার প্রার্থীদের নিষ্পত্তিকৃত মামলার রায় পেতে অবর্ণনীয় সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে যে, একটি সাধারণ মামলা নিষ্পত্তির পর ২/৩ বছরের মধ্যেও মামলার রায়ের সই-মহুরী কপি পাওয়া যায় না। তিনি নিষ্পত্তির ১/২ সপ্তাহের মধ্যে যাতে সই-মহুরী পাওয়া যায় সে বিষয়ে প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহ্য মোতাবেক জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপনার এ নিয়োগে আমরা গর্বিত ও আনন্দিত। আইন অঙ্গনে একজন দক্ষ ও যোগ্য আইনজীবী হিসেবে আপনাকে আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায়ের মধ্য দিয়ে আপনার অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। আপনি সংবিধান, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় সমান ভাবে আপনার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, তাড়াহুড়ো করে কোনো কিছু করিনি। শুধুমাত্র প্রধান বিচারপতির অবর্তমানে যিনি দায়িত্বে থাকবেন তাকে সম্মান করে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে।
হাইকোর্টের বেঞ্চ পুর্নগঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে আলোচনা করে বেঞ্চ পুর্নগঠন করা হবে।
আদালতে মামলা জটের কারণে দীর্ঘ ছুটি কোনো মতে কাম্য হতে পারে না- অ্যাটর্নি জেনারেলের এমন বক্তব্যের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, হাইকোর্টে কনিষ্ঠ বিচারপতি থাকার সময় ছুটি কমানোর বিষয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শুধুমাত্র একজন বিচারপতি একমত হয়েছেন। ছুটির নিয়মটা ব্রিটিশ শাসনামলের। আগে বিচারকরা জাহাজে করে বাড়ি যেতেন। এখন তো আর ওই সিস্টেমের দরকার নেই।
আইন পেশায় এমন বহু ব্যক্তি আছেন যারা প্রাকটিস না করে কেবল পদবী ব্যবহারের জন্য আইনজীবী হন। সেসব আইনজীবীর সনদ বাতিলে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যর বিষয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, এটা বার কাউন্সিলের রুলস মোতাবেক হয়। আইন প্রণেতারা এ বিষয়টি দেখবেন। আমরা এখানে হস্তক্ষেপ করবো না। আমরা শুধু আপিল বিভাগের বিষয়টি দেখবো।
বিচারিক আদালত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অবাধ হস্তক্ষেপ হচ্ছে- খন্দকার মাহবুব হোসেনের এ বক্তব্যের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, মোটামুটি এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। আমরা (জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন) সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। বিচারক নিয়োগ যেমন আমাদের অধীনে তেমনি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের বিষয়টিও পিএসসি থেকে যেন আমাদের অধীনে দেওয়া হয়। আর সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ছাড়া বিচারিক আদালতের কোনো বিচারককে বদলি করা যাবে না। অন্তত আমি হতে দেবো না।
মামলা জটের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি সিরিয়াসলি দেখবো।
আপিল বিভাগের রায়ের কারণে আগাম জামিন দিতে হাইকোর্টের কোনো কোনো বেঞ্চ অনীহা প্রকাশ করছেন- খন্দকার মাহবুবের এ বক্তব্যের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, এ বিষয়ে আপিল বিভাগ একটি গাইডলাইন দিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আপনারা আগাম জামিনের আবেদনে গাইডলাইনের ধারে-কাছেও থাকেন না। সঠিকভাবে আবেদন নিয়ে আসেন, আমরা দেখবো।
আর নিম্ন আদালতের জজদের বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। সারা দেশে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। কিন্তু বিচারিক আদালতে জজ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না।
হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ভারতে আইন আছে। আমাদের এখনো হয়নি। সংবিধানের বিধান মোতাবেক চিন্তা-ভাবনা করা হবে।
আপিল বিভাগে মামলা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এখন থেকে রোববারে আর আইনজীবীদের লাইনে দাঁড়াতে হবে না। চেম্বার বিচারপতির নির্ধারণ করা তারিখ অনুসারে কার্যতালিকায় মামলা উঠে আসবে। আর হাইকোর্টের যে বেঞ্চ রুল দেবেন সে বেঞ্চই রুলের শুনানি করবেন। এছাড়া পুরোনো ফৌজদারি আপিলের জন্য একাধিক বেঞ্চ গঠন করা হবে।
রোববার সকাল পৌনে এগারোটায় নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার প্রথম কর্মদিবসে এ সংবর্ধনার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
সংবর্ধনা সভায় প্রধান বিচারপতিসহ উভয় বিভাগের বিচারপতিরা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া সংবর্ধনায় অংশ নিয়েছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আজমালুল হোসেন কিউসি, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াসহ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা।
গত শনিবার (১৭ জানুয়ারি) দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা)। গত ১২ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
বিচারপতি এস কে সিনহা বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের স্থলাভিষিক্ত হলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৫
** নতুন প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনা শুরু