শেরপুর (বগুড়া): জমির সবজিগুলো এখন যৌবনকাল পার করছে। ফলে পরিপক্ক ফলগুলো আর গাছ ধরে রাখতে পারছে না।
সম্প্রতি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ‘সবজিগ্রাম’খ্যাত গাড়ীদহ ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রাম ঘুরে কৃষকদের ক্ষেতের ফসল তুলতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল।
তবে, ফসল তুলতে মুখে হাসি লেগে থাকলেও তারপরই দুঃশ্চিন্তা ভাঁজ পড়ছে কৃষকদের কপালে। বিশেষত ইদানীংকালে অবরোধের কারণে তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে প্রতিটি ফসলের দাম তিন-চারগুণ কমে গেছে। প্রান্তিক চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসলের দাম না পেলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজধানীমুখী পাইকাররা বিপুল অঙ্কের টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। তবে জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার পাশাপাশি তাদেরও আগের চেয়ে দ্বিগুণের অধিক পরিবহন ব্যয় গুণতে হচ্ছে। ফলে আগের মতোই তাদেরও সীমিত লাভ হচ্ছে বলে বেশ কয়েকজন পাইকার দাবি করেন।
স্থানীয়রা বলছেন, অনির্দিষ্টকালের অবরোধে ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়েছেন সবজিগ্রামের কৃষকরা! দুই দফা বন্যার ধকল কেটে উঠতে না উঠতে তাদের ওপর আবারও মহাবিপর্যয় নামলো যেন। বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা ব্যাপকভাবে শীতকালীন রকমারি সবজি চাষ করেছিলেন। অবরোধের ডাক আসার আগ পর্যন্ত তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের বেশ ভালো দাম পাচ্ছিলেন। কিন্তু টানা অবরোধ তাদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এমনকি অবরোধ অব্যাহত থাকলে অনেক কৃষককেই হয়তো পথে বসতে হবে। কেননা লোকসানেরও একটা সীমা থাকে। লোকসানের সীমা একেবারে নিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। আর এভাবে লোকসান দিয়ে একজন প্রান্তিক চাষি কতোদিনই-বা টিকে থাকতে পারবেন-সে প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
সাইফুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান, রেজাউল করিম, আবু রায়হান, দুলাল মিয়া, হাসনা বেগম, রাবেয়া আক্তারসহ একাধিক সবজিচাষী বাংলানিউজকে জানান, তারা মরতেও পারছেন না। আবার বাঁচতেও পারছেন না। তাদের দুর্দশার কথা কেউই ভাবছেন না। পরিবার নিয়ে তারা মহাকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। অথচ একদল ক্ষমতায় আসার জন্য আর অপরদল ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের মতো অসহায় জনগণের নাম ব্যবহার করে রাজনীতি করছে।
তারা আক্ষেপের সঙ্গে জানান, কেবল একমুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এজন্য তারা কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে সাহায্য সহযোগিতাও চান না। অথচ দেশের দু’টো বৃহৎ রাজনৈতিক দল তাদের নিয়েই দিনের পর দিন রাজনীতি করে যাচ্ছে। তারা কেবল বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চান। আর সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারলে খাওয়া পড়ার জন্য তাদের নিয়ে রাজনীতিবিদদের চিন্তা করতে হবে না। সৃষ্টিকর্তা যে শক্তি সামর্থ্য দিয়েছেন তা-ই যথেষ্ট। তা দিয়েই তারা বাঁচতে পারবেন। তারা শুধু দেশে সব সময় স্থিতিশীল অবস্থা চান। কোনো হাঙ্গামা চান না। তারা তাদের নিয়ে রাজনীতি না করতে দু’দলের কাছেই করজোড়ে নিবেদন জানান।
কৃষকরা জানান, এ ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামের মধ্যে ২০ গ্রামের কৃষকের প্রধান আবাদযোগ্য ফসল নানা জাতের সবজি। এর মধ্যে ফুলবাড়ি, চকপাথালিয়া, কালসিমাটি, গাড়িদহ, রামেশ্বরপুর, শিবপুর, দড়িপাড়া, বাংড়া, বোংগা, চন্ডিযান, দামুয়া, রানীনগর, জয়নগর, মহিপুর, রামনগর, কানুপুর উল্লেখযোগ্য।
এদিকে এসব গ্রামে উৎপাদিত রকমারি সবজি স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনী, রাজশাহী, উত্তরাঞ্চল, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। সবজিকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ফুলবাড়ি মাঠে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বিশাল পাইকারি বাজার বসে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা এসে এখান থেকে সবজি কিনে থাকেন।
পাইকারি বেপারি মোবারক আলী, আখের আলী, সাইদুল ইসলাম, তোজাম্মেল হোসেন, জাকারিয়া হোসেন, মো. পারভেজ ও হাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, অবরোধ শুরু হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত এখান থেকে প্রতিদিন ২০-২৫টি ছোট ও মাঝারি আকারের ট্রাক ও শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ভটভটিতে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সবজি পরিবহন করা হতো। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন মাত্র দুই-তিনটি ছোট ট্রাকে সবজি যাচ্ছে।
তারা জানান, অবরোধের কারণে এখানে বাইরের পাইকাররা আসতে পারছেন না। স্থানীয় কয়েকজন পাইকার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেবল রাজধানীতে সবজি নিয়ে যাচ্ছেন। তাও সকালে সবজি কিনে ট্রাকবোঝাই করেন। রাত ৯টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। পেট্রোল বোমা হামলাসহ অবরোধকারীদের হামলার আশঙ্কায় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে শেষবারের মতো দোয়া চেয়ে সবাই বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন।
পাইকাররা বাংলানিউজকে জানান, অবরোধের কারণে স্থানীয় ফুলবাড়ী বাজারে সবজির দাম একেবারে পড়ে গেছে। স্বাভাবিক সময় এই বাজারে প্রতিমণ ফুলকপি যেখানে ৪৫০-৫০০ টাকায় বিক্রি হতো, সেখানে একলাফে তা কমে ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিমণ বাঁধাকপি ৪০০-৪৫০ টাকার স্থলে ৮০-৯০ টাকায়, কাঁচা মরিচ ৭৫০-৮০০ টাকার স্থলে ৩৫০-৪০০ টাকায়, পেঁয়াজ ১২০০-১৩০০ টাকার স্থলে ৭৫০-৮০০ টাকায়, আলু ৭০০-৬৫০ টাকার স্থলে ৪৫০-৫০০ টাকায়, বেগুন ৪৫০-৫০০ টাকার স্থলে ২০০-২৫০ টাকায়, টমেটো ৯০০-১০০০ টাকার স্থলে ২৫০-৩০০ টাকায় ও শিম ৪০০-৪২০ টাকার স্থলে ১৮০-২০০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। অবরোধের কারণে প্রতিদিন সবজিখ্যাত এই ইউনিয়নের কৃষকরা আগের তুলনায় দামে কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা লোকসান দিয়ে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
যদিও এসব কাঁচামাল তারা ঢাকায় নিয়ে প্রতিমণ ফুলকপি ৪৫০-৫০০ টাকায়, বাঁধাকপি ৪০০-৪৫০ টাকায়, কাঁচা মরিচ ১১৫০-১২০০ টাকায়, পেঁয়াজ ১২০০-১৩০০ টাকায়, আলু ৭৫০-৮০০ টাকায়, বেগুন ৫৫০-৬০০ টাকায়, টমেটো ৮০০-৮৫০ টাকায়, শিম ৫০০-৬০০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করছেন।
তারা আরও জানান, অবরোধের আগে ছোট একটি ট্রাক ঢাকা যেতে ভাড়া নিতো ৭-৮ হাজার টাকা। বর্তমানে একই ট্রাক নিচ্ছে ২০-২২ হাজার টাকা ভাড়া নিচ্ছে। তাও গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া, রোড খরচ অনেকটা আগের মতই রয়েছে। মাঝখানে জীবন হারানো ও গাড়ি ভাঙচুর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে অনেক।
সবমিলিয়ে কৃষকদের মতো পাইকাররাও এই অবরোধে ভাল নেই বলে জানান।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৫