ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিট অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইসিইউ) এক নাম্বার বেডে চিকিৎসাধীন আবু তাহের। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে যাত্রীবাহী বাসে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় তার মুখ, গলা, দুই হাত, কাঁধ ও পিঠ ঝলসে গেছে।
বয়স ৭৫ পেরিয়েছে। শেষ বয়সে এসে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর আবু তাহের। দগদগে কালো ক্ষতে আবার প্যাঁচানো হয়েছে সাদা ব্যান্ডেজ। অবরোধকারীদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমার আঘাতে ঝলসে গেছে তার শরীরের ১৪ ভাগ অংশ। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি।
আইসিইউ ইউনিটের শয্যায় পোড়া ক্ষতে কাতর আবু তাহের মাঝে মাঝে প্রলাপ বকছেন, ‘ভাত দে ভাত খাবো’।
গত তিন দিন ধরে ওষুধ আর পানি ছাড়া পেটে কোনো দানা পড়েনি তার।
সোমবার (১৯ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় মেয়ে ওযুফা বেগম পিতা আবু তাহেরের কালো দগগদে ক্ষতে ওষুধ দিচ্ছেন, কখনও আবার একটু আদর দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মেয়ের এই আদর যেন সইতে পারছেন না অগ্নিদগ্ধ বাবা।
মেয়ে ওযুফা বেগম বলেন, ‘ঘায়ে (ক্ষত) ওষুধ দিলে চিক্কর (চিৎকার) পাড়ে (দেয়)। দিনে তিনবার ওষুধ দেওন লাগে। দুই ঘণ্টা পর চোখে ডরোপ (ড্রপ) দিতে হয়। কালো ঘা দিয়া রস বের হয়! তহন আরও ব্যথা করে। মুখ গলায় জ্বলে। বাপে খালি ভাতই চায়, খাইতে পারে না। খিদির (ক্ষুধা) জ্বালায় ভাত খাইতে চায়, তিনদিন ধরে ফলের রসও খাইতে পারেনি। বাপে খালি ভুল বকে। ’
আবু তাহেরের জন্মস্থান পাবনার জেলার কাজীর হাট। স্ত্রী জাহেরা বেগমের (৫৫) পা ভেঙে যাওয়ার সংবাদ শুনে ঢাকা থেকে ছুটে যান সেখানে। স্ত্রীকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পাবনা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন আবু তাহের।
বিধিবাম অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার প্রবেশ পথে মোহাম্মদপুরে অবরোধকারীদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় শরীরের ১৪ ভাগ অংশ পুড়ে অঙ্গার হয় তার।
এখন একদিকে অসুস্থ অবস্থায় মোহাম্মদপুরে পা ভাঙার যন্ত্রণায় কাতর জাহেরা বেগম, অপরদিকে আবু তাহের বার্ন ইউনিটে পাঞ্জা লড়ছেন যমের সঙ্গে।
আবু তাহেরের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে চিকিৎসকরা জানান, তার (আবু তাহের) মুখ ও বুক পুড়ে গেছে। এই সব রোগীদের বেশির ভাগেরই শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে যে কোনো মুহূর্তে তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। সেজন্য অক্সিজেন দিয়ে এখন পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
এই বিভাগের ১০ নাম্বার বেডে চিকিৎসাধীন আছেন বিল্লাল হোসেন। অবরোধকারীদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় তার শরীরেরও ২৫ ভাগ পুড়ে গেছে। বিল্লালের জন্মস্থান ভোলার চরফ্যাশানে। ঢাকার হেমায়েতপুরের একটি বাইং হাউজে চাকরি করেন তিনি। কর্মস্থল থেকে মোহাম্মদপুরে ফেরার পথে পেট্রোল বোমার আঘাতে হাসপাতালের শয্যাশায়ী তিনি।
আইসিইউ বিভাগের ৯ নাম্বার বেডে পোড়ার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আবু বক্কর সিদ্দিক। তার জন্মস্থান রাজশাহীর বানেশ্বর। ১৫ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৭টায় যমুনা সেতু সংলগ্ন কড্ডর মোড়ে অবরোধকারীর হামলার শিকার হন তিনি। তার শরীরের ১৫ ভাগ পুড়ে অঙ্গার।
দিন মজুর স্বামীর পাশে হতাশা ও ক্ষোভকে সঙ্গী করে বসে আছেন পারভিন বেগম।
স্বামীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই কণ্ঠে দেশের রাজনীতি নিয়ে ক্ষোভ ঝরে তার। তিনি বলেন, ‘যারা আমার স্বামীকে পেট্রোল দি মাইরিচে, তাদেরকে ফাইড়ি ফেলতে ইচ্ছা হয়। একবারে মারলে তো মইরিই গেল, পেট্রোল দি তাদের মারতে মারতে মাইরি ফেলতে হবে। তাইলে পুড়ার (পোড়া) জ্বালা বুইঝবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৫