জাতীয় সংসদ ভবন থেকে: পিনপতন নীরবতা জাতীয় সংসদে। একের পর সহিংসতার দৃশ্যের দেখা মিলছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
একটু থেমে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবার শুরু করেন। নতুন করে কথা বলতে গিয়ে সহিংসতার চিত্র তুলে ধরলেন। আবারও কেঁদে ফেলেন তিনি।
এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ না করে তার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন খুনির যে বিচার, সে বিচারই হবে।
আর বাংলাদেশের মাটিতেই সে বিচার হবে। পরে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ করেন তিনি।
একজন খুনির সঙ্গে আমাকে মেলাবেন না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সঙ্গে (খালেদা জিয়া) আমাকে মেলাবেন না।
বুদ্ধিজীবীদের ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একশ্রেণীর আঁতেল আমাকে তার সঙ্গে মেলাতে চান। এটা করবেন না। তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
সাম্প্রতিক নির্মমতার চিত্র তুলে ধরে দেশবাসীর সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী। প্রতি পাড়া-মহল্লায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী কমিটি করে জড়িতদের ধরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন পুরস্কার দেওয়ার জন্য।
এসময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে পুরস্কারের অর্থ নির্দিষ্ট করতে বলেন তিনি।
মঙ্গলবার (২০ জানুয়ারি) রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার আগে প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে যান সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষিত আলোচনায়। বিএনপির অবরোধ সহিংসতায় বিরোধী দলীয় নেতার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেন।
বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমস্ত্রী বলেন, বিষয়টি সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা তুলে ধরেছেন। সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নববর্ষ মানুষ পালন করবে। অথচ এবার দুঃখজনক ২০ দলের বিষ দংশনে দেশের মানুষ ধ্বংস হচ্ছে। ২০ দল বিষধর সাপ হয়ে দেশের মানুষকে ধ্বংস করছে। দেশের মানুষকে পুড়িয়ে মারছে।
নির্বাচনে সহিংসতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বিএনপি) নির্বাচন বন্ধ করার নামে দুইজনকে হত্যা করলো। ড্রাইভার ও হেলপারকে হত্যা করলো। আগুন দেওয়া গাড়ি থেকে ড্রাইভারকে বের হতে দেয়নি। যে ড্রাইভার বের হয়ে গেছেন, তার গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রেলের ফিসপ্লেট খুলে ফেলা, মানুষকে মারা চেষ্টা করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এখন আর সারাদেশে হাহাকার নেই। মানুষের মুখে খাবার রয়েছে। কৃষক ফসল উৎপাদন করেছে। অথচ তাদের ফসল বাজারজাত করতে পারছেন না। পেঁয়াজসহ খাবার পণ্যে আগুন দিচ্ছে যেন মানুষ খেতে না পায়। অন্তঃস্বত্ত্বা নারীকে পুড়িয়েছে। সিএমএইচে ডেলিভারি করা হয়েছে। মঙ্গলবার ভোর রাত তিনটার দিকে শিশুটি মারা গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, শিক্ষিকাকেও হত্যা করলো তারা, কী দুর্ভাগ্য! সরকারি কর্মকর্তারাও রক্ষা পাননি। বিশ্ব এজতেমাও বাদ দেওয়া হয়নি। উনি (খালেদা জিয়া) নিজেও এজতেমায় যেতেন। এবার তাদের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলেন না। ঈদ-ই মিলাদুন্নবী মানুষ সব সময় পালন করেন। সেই দিনটির প্রতিও সম্মান দেখাননি তিনি।
১৯ জানুয়ারি জিয়াউর রহমানের জন্মদিন ছিল। উনার প্রেস ব্রিফিংয়ের কাগজে কোথাও দেখিনি তার (জিয়াইর রহমান) কথা। স্বামীর জন্মদিনের কথা কোথাও দেখতে পেলাম না, কিন্তু প্রেস বিফিংয়ে মিথ্যা বলেছেন। মিথ্যা বলা উনাদের অভ্যাস। উনি দোষ করেছেন, আর দোষ দিলেন সরকারের উপর। অবশ্য উনি গ্রেনেড হামলার সময় বলেছিলেন, আমি নাকি গ্রেনেড সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। এটাই নাকি তাদের আন্দোলন। এরকম আন্দোলন আমরা দেখিনি। আমরা আন্দোলন করেছি জনগণ সম্পৃক্ত করে। আন্দোলন মানে জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
খালেদা জিয়ার মিথ্যাচারের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া নাকি বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ’র টেলিফোন পেয়েছেন, বড় বড় করে হেড লাইন হয়েছে পত্রিকায়। তার পর জানা গেল কথা বলেননি।
মিথ্যা বিবৃতির পর কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জাল নিয়ে কটাক্ষ করেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া নিজে যত অপকর্ম করেছেন, সেসব দোষ এখন সরকারের। তাকে নাকি অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তিনি কিছুদিন আগে নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। আর নিরাপত্তা দিতে গেলেই নাকি অবরুদ্ধ করা হয়।
সংলাপ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ফোন করেছিলাম। ফোন করে আমি যে রুঢ় ব্যবহার পেয়েছি, আমি এধরনের অভ্যাসে অভ্যস্ত নই।
আমি তাকে বলেছিলাম, যে মন্ত্রণালয় চান আমি দেবো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও দিতে চেয়েছি। সর্বদলীয় সরকার করারও কথা বলেছি। উনি তাতেও রাজি হননি। জামায়াত নিবন্ধিত দল নয়, তারা আসতে পারেনি। তাই বিএনপি আসেনি, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, যখন নির্বাচনের এক বছর পূর্তি হয়েছে, তখন আবার শুরু করেছেন। বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের রোল মডেল, মানুষ যখন সুখে থাকে, তখনই হায়েনার আঘাত নেমে আমে। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, দিনমজুরদের সব কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে। বাসে-ট্রেনে চড়ে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষকে হত্যা করতেই তাদের আক্রোশ। এত মানুষকে হত্যা করা হলো, তাদের ব্যাপারে উনি (খালেদা জিয়া) কিছু বলেননি।
পুড়ে যাওয়া মানুষদের চিকিৎসার নির্দেশনা দেওয়া আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডাক্তারকে নির্দেশ দেওয়া আছে। তবে পুড়ে গেলে তাকে সুস্থ করে তোলা হলেও, কাজ করে খাওয়ার মতো অবস্থা কি থাকে!
অবরোধ-নাশকতায় নির্মমতার স্থিরচিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী স্পিকারের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি ছবিগুলো দেখাতে চাই। স্পিকারকে ছবিগুলো বক্তব্যের অংশ হিসেবে সংসদ বক্তব্যে গ্রহণ করার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দিনে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরকর্মীদের হামলার কথা উল্লেখ করে বলেন, ছবি তো কথা বলে। যারা বোতলে পেট্রোল দিয়ে আগুন দিচ্ছে, তাদের ছবিসহ ছাপা হয়েছে। কীভাবে অস্বীকার করবেন! ছবি থেকেই বের করা যায় কারা করেছে।
রংপুরের মিঠাপুকুরের শিশুর উপর হামলার দৃশ্য তুলে ধরে কান্নায় চোখ মোছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজশাহীতে শিবিরের পুলিশ হত্যাসহ রাজধানীর মুগদা, কমলাপুর, ফেনিসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
খালেদা জিয়া তার নেতৃত্বে ও ঘোষণায় যে আন্দোলন চলছে তা সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী কার্যক্রম উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে কোনো জঙ্গির স্থান থাকবে না। বিশ্বের নেতারাও এ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। ছাত্রদলের যে কর্মীরা বোমা হামলা করতে গিয়ে মারা পড়েছেন, তা তার জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের জন্যই।
আর এটা বিএনপি নেত্রীর নির্দেশেই হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তার সরকার সহনশীলতার সঙ্গে এগুচ্ছে। কারণ সরকার দেশের সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। আমরা রাজনীতি করি দেশের মানুষের জন্য আর খালেদা জিয়ার রাজনীতি তার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চান বলেই দেশ জুড়ে এখন জঙ্গিবাদী কার্যক্রম শুরু করেছেন।
বেঁচে থাকতে দেশে জঙ্গিবাদকে মাথাচাড়া দিতে দেবেন না ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের একটি ক্ষেত্রে পরিণত করতে দিতে পারি না। এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা রয়েছে। আমি বেঁচে থাকতে এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান হতে দেব না।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন সময় হবে তখন নির্বাচন হবে। তার জন্য প্রস্তুতি নেন।
তারেক জিয়াকে গ্রেনেড হামলা, দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচতে ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্যই তিনি মানুষ খুন করে যাচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫
** ‘খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাচ্ছেন’