ঢাকা, শনিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

হত্যা করে মাটিচাপার নির্দেশ দেন হাসান আলী

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫
হত্যা করে মাটিচাপার নির্দেশ দেন হাসান আলী

ঢাকা: রাজাকাররা আমার কাকা জীবন ঠাকুরকে নৌকা দিয়ে নদী পার করে আড়াইউড়া গ্রামের কামিনী ঘোষের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রথমে কামিনী ঘোষ ও পরে আমার কাকা জীবন ঠাকুরকে মহিন্দ্র সরকারের খালি জায়গায় নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেন হাসান দারোগা।

এছাড়া বাড়ি-ঘরও লুট করে নিয়ে যায় রাজাকাররা।

তারা শুধু হত্যাই করে না। পরে বলে যায়, এ লাশগুলো পোড়ানো যাবে না। মাটিচাপা দিতে হবে। এছাড়া জীবিত সবাইকে মুসলমান হতে হবে।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা) পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানকালে এসব কথা বলেছেন বাঁধন চক্রবর্তী।   তিনি হাসান আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম সাক্ষী।

বুধবার (২১ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন বাঁধন চক্রবর্তী। সাক্ষ্যগ্রহণে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মাদ আলী। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন হাসান আলীর পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি হাসান আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১২তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

বর্তমানে ৫৮ বছর বয়সী সাক্ষী বাঁধন চক্রবর্তী কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার চিকনি গ্রামের বাসিন্দা।

সাক্ষী বাধন চক্রবর্তী বলেন, ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর বাংলা আশ্বিন মাসের শুক্রবার আনুমানিক ২টার সময় আমার জেঠাতো ভাই সাধন চক্রবর্তী, কাকাতো ভাই নারায়ণ চক্রবর্তী এবং ছোট ভাই চন্দন চক্রবর্তী মিলে গ্রামের উত্তর দিকে পুরুড়া বাজারে যাই। বাজারে লোকজনের মুখে জানতে পারি যে, রাজাকাররা আড়াইউড়া গ্রামে আক্রমণ করেছে।

আমরা ধারণা করি রাজাকাররা আমাদের চিকনি গ্রামেও আক্রমণ করতে পারে। এ ধারণা থেকে আমরা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা করি। বাড়িতে আসার পথে মুচিবাড়ির কাছে পৌঁছে দু’টি গুলির শব্দ শুনি।

লোকমুখে শুনতে পাই যে, রাজাকাররা আমার কাকা জীবন ঠাকুর ও কামিনী ঘোষকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। খবর শুনে বাড়ির দিকে দৌঁড়াতে থাকি। বাড়ি পৌঁছে দেখতে পাই যে,  আমার মা গৌরী রানী চক্রবর্তী এবং কাকি মিলন রানী চক্রবর্তী দু’জনেই কান্নাকাটি করছেন।

তারা দু’জনেই আমাকে জানান যে,  আমরা বাজারে যাওয়ার পরেই রাজাকার আসগর আলীর নেতৃত্বে পাঁচ রাজাকার কাকা জীবন ঠাকুরকে ধরে পিঠমোড়া করে বেধে নিয়ে গেছে।

সাক্ষী বলেন, তখন মা ও কাকি বাধা দিলে রাজাকাররা তাদের গায়ের অলঙ্কার (স্বর্ণালঙ্কার) খুলে নেয়। রাজাকার আসগর আলী মা-কাকিকে বলেন, টাকা দিলে কাকাকে ছেড়ে দেবে। তখন কাকি তাকে তিনশ’ টাকা দেন।

টাকা পাওয়ার পর রাজাকার আসগর বলেন, এই মুহূর্তে জীবন ঠাকুরকে ছাড়তে পারবো না। আমাদের কমান্ডার আড়াইউড়া গ্রামের হাসান আলী দারোগার হুকুম ছাড়া তাকে ছাড়া যাবে না। আসগর আলী কাকাকে নিয়ে নৌকায় করে নদী পার হয়ে আড়াইউড়া গ্রামের দিকে রওনা দেন। তখন একজন দালাল যার নাম সোলজার তিনি বলেন, জীবন ঠাকুরের গোয়ালের পাঁচটি গরু পাশের গ্রামে হাসান আলীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে।  

সাক্ষী বলেন, রাজাকাররা কাকাকে নৌকা দিয়ে নদী পার করে আড়াইউড়া গ্রামের কামিনী ঘোষের বা‍ড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কাকা জীবন ঠাকুর ও কামিনী ঘোষকে মহিন্দ্র সরকারের খালি জায়গায় নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেন হাসান দারোগা। এছাড়া বাড়ি-ঘরও লুট করে নিয়ে যায় রাজাকাররা।

সাক্ষি বাঁধন চক্রবর্তী বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে আড়াইউড়া গ্রামে উপস্থিত হই। সেখানে গিয়ে দেখি যে, কামিনী ঘোষের ছেলের বৌ রেখা রানী ঘোষসহ অন্যরা কান্নাকাটি করছেন। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা বাড়ি-ঘর লুট ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।

তারা আরো জানান যে, যিনি গুলি করেছেন তার নাম হাসান দারোগা।

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর শুরুর পর থেকে হাসান আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরও দশজন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন, শহীদপুত্র রেনু চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র সমেন্দ্র চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র সুনীল চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র খগেশ চন্দ্র পাল, নূরুল হক লাল মিয়া, রাহিমা ওরফে আবুনি, মোঃ এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া, মোঃ শাহজাহান ভূঁইয়া, রেখা রানী ঘোষ এবং সঞ্জিব কুমার সরকার।
 
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।

গত বছরের ১১ নভেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, আটক ও নির্যাতনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে ২৪ জনকে হত্যা, ১২ জনকে অপহরণ ও আটক এবং ১২৫টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ রয়েছে।

গত বছরের ২২ অক্টোবর ও ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ। অন্যদিকে ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন হাসান আলীর পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান।

গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর অনুপস্থিতিতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় আব্দুস শুকুর খানকে রাষ্ট্রীয় খরচে আসামিপক্ষের আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আগে থেকেই পালিয়ে থাকা হাসান আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের ২৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই পলাতক এই রাজাকার কমান্ডারকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। পরে তাকে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন প্রসিকিউশন।

গত বছরের ২১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ।

গত বছরের ২৯ জুন সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর বিরুদ্ধে ৪৭ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করেন তদন্ত সংস্থা।

হাসান আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর গত সাড়ে ৯ মাসেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।

২০১৩ সালের ৬ জুন থেকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন তদন্ত সংস্থা। গত বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা হরি দেবনাথ।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন হাসান আলী। সে সময় তিনি তাড়াইল থানা এলাকায় ‘রাজাকারের দারোগা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে না থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা গ্রামে বসবাস করতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রাস ছিলেন রাজাকার হাসান আলী। হাসান আলী অন্যান্য সহযোগীসহ তাড়াইল থানার বিভিন্ন এলাকাসহ কিশোরগঞ্জে নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, বাড়িঘর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জোর করে টাকা আদায় ও ধর্মান্তরিতকরণসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। তার নির্দেশেই তাড়াইলে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে।

রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকাণ্ডে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি।

সৈয়দ হাসান আলীর পিতা সৈয়দ মোসলেম উদ্দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তার অন্য এক ভাইও রাজাকার ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।