ঢাকা, শনিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ঘুষ-দুর্নীতির ‘রসের হাঁড়ি’ ইউনিয়ন ভূমি অফিস

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫
ঘুষ-দুর্নীতির ‘রসের হাঁড়ি’ ইউনিয়ন ভূমি অফিস ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গৌরীপুর, ময়মনসিংহ ঘুরে: ২০ জানুয়ারি, মঙ্গলবার। সকাল ১১টা।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ৮ নম্বর ডৌহাখলা ইউনিয়ন ভূমি অফিস। অফিসের সামনে গিজগিজ করছেন সেবাপ্রার্থীরা। কিন্তু অফিসে নেই কেউ। দরজায় তালা ঝুলছে। গোমড়া মুখ নিয়ে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষেদ ঝাড়ছিলেন তাঁতকুড়া থেকে আসা ক্ষিরোদ চন্দ্র দাস (৪৮)।

বলছিলেন নিজের ৩৬ শতাংশ জমির নামজারি (নাম খারিজ) করতে মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে। ঘুষ না দেয়ায় কাজ হচ্ছে না। ক্ষিরোদের কথায় ‘ঠিক ঠিক’ আওয়াজ তুলে সায় দিচ্ছিলেন নামজারি ও খাজনা দিতে আসা অন্যান্য সেবা প্রত্যাশীরাও। নামজারি, ডিসিআর ও দাখিলার নামে এখানে অবাধে চলা ঘুষ-বাণিজ্যের রমরমা অবস্থার চিত্র তুলে ধরতে তারাও হয়ে উঠেন সরব।

Dowhakhala_Vumi_office_mymensingh_2ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাখঢাক না করেই সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা থেকে শুরু করে  অফিসের পিয়ন, ঘুষ-দুর্নীতির ‘রসের হাঁড়িতে’ মজে অনিয়মকে রূপ দিয়েছেন নিয়মে! আর এতে করে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী লোকজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও কোন ফল হয় না। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনও দুর্নীতির দুষ্টচক্রের পক্ষেই উল্টো সাফাই গান, এমন নেতিবাচক নজিরও তাদের ফেলে দিয়েছে প্রশ্নের মুখে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ৮ নং ডৌহাখলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না। নামজারি (নাম খারিজ), ডিসিআর ও দাখিলার জন্য তাকে আলাদা আলাদা টাকা দিতে হয়। কখনো টাকা দিলেও জুটে না নামজারি।

খাজনার দাখিলার জন্য (ভূমি উন্নয়ন করের রসিদ) সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়েও অতিরিক্ত টাকা আদায় করলেও আবার রশিদ দেয়া হয় সরকারি হিসাবেই। এসবের মাধ্যমে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা। দৌরাত্ম বেড়েছে দালাল সিন্ডিকেটেরও।

ঘুষ-দুর্নীতির খণ্ড খণ্ড নমুনা
তাঁতকুড়া মৌজার ১১৬ নম্বর খতিয়ানের ৩৬ শতাংশ জমি নাম খারিজ করতে ক্ষিরোদ চন্দ্র দাস প্রায় এক বছর আগে এ ভূমি অফিসে যান। আগের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ৮ হাজার টাকা দাবি করায় রাগে-ক্ষোভে কয়েক মাস অফিসের চৌহদ্দীতেও ভিড়েননি তিনি।

অন্য উপায় না পেয়ে গত ৫ থেকে ৬ মাস ধরে ঘুরাঘুরি করছেন অফিসের বারান্দায়। ক্ষিরোদ বলেন, ‘নামজারির জন্য ফি আসে ২৫০ টাকা। আমি আপার (ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা) কাছে অনেকবার গেছি। প্রথমবার কয় অসুবিধা আছে, মেম্বার লইয়া আসেন। এরপরও কাম হয় নাই। কয় চেনাজানা লোক নিয়া আহেন, কাম অইবো। পরে দালাল ধইরা গেলে আপা ৭ হাজার টাকা চান। আমি এই টাকাও দিতে পারতাছি না। আমার নামজারিও হইতাছে না। ’

ঘুষ দাবির অভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন একই মৌজার জমির মালিক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, ‘আমার ২.৩৭ শতাংশ জমির খাজনা চেক কাইট্যা দিতে দু’মাস ধইরা নায়েবরে কইতাছি। তিনি ১৬ হাজার টাকা চাইছেন। আব্দুল লতিফ মেম্বাররে দিয়া সুপারিশ কইরা ৬ হাজার টাকায় রাজি করছি। পুরো টাকা দিলেও রশিদে লিখছে মাত্র ১ হাজার টাকা। ’ 

চুড়ালী মৌজায় ১১.২৯ (এগার একর উনত্রিশ শতাংশ) একর জমির খাজনা বাবদ ২০১১ সাল পর্যন্ত বছরে ১ হাজার ১২৯ টাকা দিয়ে আসছিলেন স্থানীয় ডৌহাখলা ইউনিয়নের বাসিন্দা শ্রী মনীন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিক। ২০১৩ সালের খাজনা দিতে গেলে স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা এক লাফে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন।

Dowhakhala_Vumi_office_mymensingh_4মনীন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিক জানান, আমি পরদিন আবারো আমার জমির আংশিক খাজনা দিতে গেলে তিনি খাজনা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এবং খাজনা বাবদ আগের দিনের ৩০ হাজার টাকার পরিবর্তে ১ লাখ টাকা দাবি করেন। তখন আমি তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আইনে খাজনা বাবদ ১ লাখ টাকা আসে।

দেড় বছর পর ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি আবারো তাঁতকুড়া মৌজায় ২.১৩ (দুই একর ১৩ শতাংশ) জমির খাজনা দেয়ার জন্য নিজের কাকাতো ভাইকে ভূমি অফিসে পাঠান মনীন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিক। কিন্তু এ ভূমি কর্মকর্তা কাগজ দেখে খাজনা আদায়ে আপত্তি তোলেন।

যাচ্ছেতাই আচরণ করে তাকে জানিয়ে দেন, এ ব্যক্তির কোনো খাজনা নেয়া যাবে না। রাখঢাক না করেই বলেন, খাজনা নিতে হলেই আগের দাবি মোতাবেক সমুদয় টাকা দিতে হবে। কিন্তু ২০১১ ও ২০১৩ সাল পর্যন্ত দুই মৌজার খাজনা পরিশোধের রশিদ তাদের কাছে রয়েছে।

শ্রী মনীন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিকের পুত্র অমিয় দত্ত ভৌমিক মোবাইল ফোনে এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে তাকেও হুমকি দেন এবং তার সিন্ডিকেট সদস্যদের মোবাইল ফোনে লেলিয়ে দেন এ ভূমি কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত অভিযোগ গড়িয়েছে স্থানীয় উপজেলা ভূমি অফিসে।

ভুক্তভোগীরা আরো অভিযোগ করেন, নাসরিন সুলতানা’র ঘুষ বাণিজ্য’ অনিযম’ দুর্নীতি ও নিজের নিয়োজিত দালাল-কর্মচারী সিন্ডিকেটের উৎপাতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। গোটা ভূমি অফিস হয়ে উঠেছে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া। এক্ষেত্রে ভয়ভীতিরও বালাই নেই।

ইচ্ছামতো অফিসে আসা-যাওয়া করেন তিনি
Nasrin_Sultana_mymensingh_1নিজের ইচ্ছামাফিক অফিসে-যাওয়া করেন ৮ নং ডৌহাখলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা, এমন অভিযোগ করেন স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি মিজানুর রহমান রতন। মঙ্গলবার সকাল ১১টার মধ্যে ভূমি অফিস তালা দিয়ে চলে যাবার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ‘তিনি মনমত অফিস করেন। একদিন এলে আরেকদিন আসেন না। প্রায় সময়েই সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য অফিস খুললেও দুপুর হতে না হতেই অফিস বন্ধ করে চলে যান। এ সময় কোনো পিয়নও অফিসে থাকেন না। ’

স্থানীয় চায়ের দোকানি আমির হোসেন বলেন, ‘নায়েব মহিলা প্রকাশ্যেই বলেন টাকা খরচ কইরা এইখানে আইছি। এমনে টাকা কামাই না করলে তো অইবো না। উপরেও তো কমিশন দিতে অয়। ’

স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক লিটন জানান, কেউ জমি বিক্রির খাজনার চেক আনতে গেলে এ কর্মকর্তা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। এরপর যার কাছ থেকে যত নিতে পারেন। ’

অফিসে তালা দিয়ে উপজেলা ভূমি অফিসে
Dowhakhala_Vumi_office_mymensinghমঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে নিজের অফিসে তালা দিয়ে স্থানীয় উপজেলা ভূমি অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন নাসরিন সুলতানা। টাকা ছাড়া কোন কাজ না করার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে যারা ফলস কোন কাজ করতে না পারে তারাই আমার নামে এসব অপপ্রচার চালায়। অবৈধ কোনো কাজ আমার দ্বারা কখনো হয়নি। আমি কোন দুর্নীতি করি না। ’

অফিস বন্ধ করে এ অফিসে বসে আড্ডা দেয়ার বিষয়ে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করা হয়েছে। এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার-ভূমি) ম্যাডাম খবর পাঠিয়েছেন। আমাদের অনেকগুলো বইখাতা এখানে নিয়ে আসতে হয়েছে। এ কারণে অফিস বন্ধ করে সব স্টাফকে নিয়ে এখানে এসেছি। ’

শ্রী মনীন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিকের কাছে জমির খাজনা বাবদ ১ লাখ টাকা দাবির বিষয়ে নাসরিন সুলতানা বলেন’ চুড়ালি মৌজার ১৩ একর ২৩ শতাংশ জমির খাজনা বাবদ ১ লাখ টাকা দিতে হবে। প্রায় ৩০ বছর তিনি কোনো খাজনা পরিশোধ করেননি। তিনি শুধু এতোদিন তাঁতকুড়া মৌজার খাজনা দিয়েছেন। ’

তাহলে আগের দিন ৩০ হাজার টাকা কিভাবে চেয়েছিলেন জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি নাসরিন সুলতানা।

তবে মনীন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিকের কাকাতো ভাই প্রাণেশ দত্ত ভৌমিক এ বিষয়ে বলেন, চুড়ালী ও তাঁতকুড়া মৌজায় ২০১১ ও ২০১৩ সাল নাগাদ আমাদের খাজনা দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত কাগজপত্রও আমাদের কাছে আছে। তিনি ঘুষ হিসেবেই আমাদের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেছেন।

এসি ল্যান্ডের বয়ান 
স্থানীয় ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানার বেপরোয়া অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রথমবারের মতোই একটি অভিযোগ পেয়েছেন বলে দাবি করেন উপজেলা সহকারী কর্মকর্তা (ভূমি) কাউসার আজিজ। মনীন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিকের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, তার কাছে অতিরিক্ত কোনো টাকা দাবি করা হয়নি। জমির খাজনা বাবদ সুদ মওকুফ করেও ১ লাখ টাকার বেশি আসে।

যাচাই না করেই কেনো নাসরিন সুলতানার পক্ষে অবস্থান নিলেন জানতে চাইলেও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

অফিস বন্ধের বিষয়ে কাউসার আজিজ জানান, অভিযোগের তদন্ত করতেই তাদের ডাকা হয়েছিল। দুপুরের পর সবাই অফিসে ফিরে গেছেন। ’ তবে ওইদিন শেষ পর্যন্ত আর কাউকেই অফিসে ভিড়তে দেখা যায়নি। ‘কিন্তু এভাবে ইউনিয়ন ভূমি অফিস বন্ধ রাখার নিয়ম আছে কী না জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।  

বাংলাদেশ সময় ১০৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।