ঢাকা, শনিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ডা. দেবেন্দ্র হত্যার ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখেছি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫
ডা. দেবেন্দ্র হত্যার ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখেছি ফোরকান মল্লিক

ঢাকা: পাকিস্তানি সেনাদের একজন পকেট থেকে কাগজ বের করে ফোরকানের দিকে তাকান। তখন ফোরকান মল্লিক বলেন, ইনিই দেবেন্দ্র ডাক্তার।

এ সময় একজন পাকিস্তানি সেনা দেবেন্দ্র নাথ বাবুকে গুলি করে হত্যা করেন।

এ ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। কারণ, আমার দোকান ছিল বাবুর ঘরের পাশেই। আমি সেখানে লবণ বিক্রি করতাম।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন মো. চাঁন মিয়া। তিনি ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী।

বৃহস্পতিবার (২২ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেন মো. চাঁন মিয়া। সাক্ষ্যগ্রহণে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল ও সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নি।

সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

বর্তমানে ৬৯ বছর বয়সী মো. চাঁন মিয়া পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জ উপজেলার ছৈলাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা। মৃত মমিন উদ্দিনের ছেলে চাঁন মিয়া একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুবিদখালী বাজারে লবণের ব্যবসা করতেন।

সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ শ্রাবণ বেলা দেড়টা থেকে পৌনে দুইটার দিকে সুবিদখালী বাজারের ধানহাট খোলায় পাকিস্তানি সৈন্যরা গানবোট নিয়ে আসে। এ সময় রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান সিকদারসহ পাকিস্তানি সেনাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বাজারে নিয়ে আসেন রাজাকার ফোরকান মল্লিক ও বেলায়েত চৌকিদার।

মো. চাঁন মিয়া বলেন, বেলা দুইটার দিকে কাদের জমাদ্দারকে দড়ি দিয়ে বেধে ডাক্তার দেবেন্দ্র নাথের ঘরের সামনে নিয়ে আসে রাজাকাররা। এ সময় রাজাকার ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান সিকদার ও পাকিস্তানি সেনারা দেবেন্দ্র ডাক্তারের ঘরের ভেতরে ঢোকেন। পাকিস্তানি সেনাদের একজন পকেট থেকে কাগজ বের করে ফোরকানের দিকে তাকান। তখন ফোরকান মল্লিক বলেন, ইনিই দেবেন্দ্র ডাক্তার। পাকিস্তানি সেনা তখন ডাক্তার বাবুকে অনেকগুলো লাথি মেরে ফেলে দেয়। এ সময় ডাক্তারের স্ত্রী কাকুতি-মিনতি করে বলেন, ‘দয়া করে মারবেন না। আমাদের সম্বল যা আছে নিয়ে যান’।

এ সময় একজন পাকিস্তানি সেনা দেবেন্দ্র নাথ বাবুকে গুলি
করে হত্যা করেন।

সাক্ষী বলেন, এ ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। কারণ, আমার দোকান ছিল বাবুর ঘরের পাশেই। আমি সেখানে লবণ বিক্রি করতাম।

সাক্ষী চান মিয়া বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ শ্রাবণ আমি দোকান খুলে বসলে বেলা ১২টার দিকে দেখতে পাই রাজাকার ফোরকান মল্লিক, কমান্ডার শাহজাহান ও বেলায়েত চৌকিদারসহ অনেক রাজাকার রমণী কুণ্ডু, শ্যাম কুণ্ডু ও সুন্দর কুণ্ডু- এ তিন ভাইকে সুবিদখালী বাজারে অবস্থিত তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে পুরোনো হাসপাতালে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

এ সময় তারা ধুতি পরা ছিলেন। কিন্তু বিকেল ৪টার সময় যখন তারা ফিরে আসেন তখন তাদের পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি দেখতে পাই। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা দু:খ করে বলেন, এদেশে আর থাকা যাবে না।

সাক্ষী বলেন, বাংলা ৩১ শ্রাবণ রাত ৮টার দিকে  দেখি, ফোরকান মল্লিক, রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান ও বেলায়েত রামচন্দ্র সাহার মেয়ে গোলাপী রানীকে যুগি বাড়ির সুপারি বাগানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি গোলাপী রানীকে চিনতাম। সে তখন অবিবাহিত ছিল এবং স্কুলে যাতায়াত করতো।

পরদিন সকালবেলা দোকান খুলতে এসে আমি শান্তি কবিরাজ ও গঙ্গাচারণ আলাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘গতরাতে
গোলাপী রানীকে নিয়ে গেল, তার খবর কি?’

এ সময় তিনি বলেন, ‘দাদা আর বলিস না, যা হবার হয়ে গেছে। ওরা ভোররাতে গোলাপীকে রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে মৃত্যুবরণ করে। আমরা তার লাশ শ্মশানে নিয়ে মাটিচাপা দিয়েছি’।

সবশেষে ললিত কর্মকারের কন্যা শোভারানী ও তার পুত্রবধূর ওপর রাজাকার ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান ও বেলায়েতের নির্যাতনের বর্ণনা দেন সাক্ষী মো. চাঁন মিয়া।

গত ১৯ জানুয়ারি শুরু হয়ে এর আগে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী মো. হাবিবুর রহমান বাদশা।

১৯ জানুয়ারি ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল।

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও দেশান্তরকরণের ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৮ জনকে হত্যা ও গণহত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্মান্তরকরণ, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরকরণ, ৬৪টি বসতঘর ও দোকানপাটে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।

এর আগে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। বিপক্ষে শুনানি করেন ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান।

গত বছরের ২ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১৭ নভেম্বর এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। পরে তিনি অভিযোগ আমলে নেওয়ার পক্ষে শুনানি করেন।

গত বছরের ২৭ অক্টোবর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত সংস্থা। ২৮ অক্টোবর এ প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হয়।

গত বছরের ২৬ জুন শুরু করে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।

ফোরকানের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ছইলাবুনিয়া গ্রামে। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বছরের ২৫ জুন সকালে পটুয়াখালী গোয়েন্দা শাখার একটি দল বরিশালের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ফোরকান মল্লিককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ২০০৯ সালের ২১ জুলাই ফোরকানের বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় তিনি উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের জামিন নেন। গত বছরের ৩০ মার্চ বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে তার বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, খুন, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পান পটুয়াখালীর আদালত। তখন মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ মামলাটি গত বছরের ২৫ জুন তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠান। তদন্ত সংস্থা মামলাটি গ্রহণ করে ২৬ জুন থেকে তদন্ত শুরু করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।
 
গত বছরের ৩০ জুন ফোরকান মল্লিককে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানো (শ্যোন অ্যারেস্ট) ও তদন্তের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর আবেদন জানান প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। শুনানি শেষে ফোরকান মল্লিককে ৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর জন্য কারা মহাপরিদর্শককে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

৩ জুলাই ফোরকান মল্লিককে হাজির করা হয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে (শ্যোন অ্যারেস্ট) কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।