মিরপুর বাজার থেকে: আমাদের সবজি খেয়ে গলাবাজি করছেন মন্ত্রী-এমপিরা। কিন্তু আমাদের স্ত্রী-সন্তান দু’বেলা খাবার পায় না।
সাভারই সচল করে রেখেছে ঢাকাকে। অথচ মনে শান্তি নেই সাভারবাসী চাষি, ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিকদের।
রাজধানীর মিরপুর শাহআলী বাজারে বাঁধাকপির পসরায় বসে কৃষক আফসার উদ্দিন এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাংলানিউজের কাছে।
সাভার থানার শ্যামপুর (হেমায়েতপুর) গ্রামের এই বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় শনিবার (০৭ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাত দেড়টায়।
হরতাল-অবরোধে কীভাবে চলছে ঢাকার বাজার? এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেরিয়ে এলো ‘সাভারেই সচল ঢাকা’- এমন তথ্য।
আফসার উদ্দিনের দাবি, মিরপুর বাজারের ৯৮ শতাংশ, গাজীপুর চৌরাস্তা ও বাইপাইল বাজারের ৯৫ শতাংশ, কারওয়ানবাজারের ৮০ শতাংশ, যাত্রাবাড়ী বাজারের ৭০ শতাংশ সবজির যোগানই সাভার ও সিঙ্গাইর এলাকা থেকে আসছে।
হরতালের কারণে দূরের জেলাগুলো থেকে সবজি আসছে কম। এতোদিন নরসিংদী এলাকা থেকে কিছু সবজি (ফুলকপি ও বাঁধাকপি) আসতো, সেগুলোও শেষ হয়ে গেছে। এখন সাভারের ওপরই নির্ভরশীল রাজধানী।
সাভারের বিভিন্ন এলাকা থেকে সড়ক ও নদীপথে রাজধানীতে আসছে নানা রকম শাক-সবজি। যে কারণে টানা হরতাল-অবরোধের খুব একটা প্রভাব পড়েনি রাজধানীর কাঁচাবাজারে। সাভারের সবজি না এলে এতোদিনে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।
আফসার আলী জানান, নিজের ক্ষেতের পাশাপাশি অন্য চাষিদের কাছ থেকে জমিতেই ১৫শ’ বাঁধাকপি কিনেছিলেন। কিন্তু বিক্রি শেষে লাভের পরিবর্তে ৫ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। ক্ষতি পূরণের চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে তার।
লোকসান হওয়ার কারণ হিসেবে আফসার জানান, তারা সিলেটসহ বিভিন্ন বাজারেও সবজি নিয়ে যেতেন। এখন ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে পারছেন না। এছাড়া বেড়েছে পরিবহন ব্যয়ও। আগে মিনি ট্রাকের (৩ টন সাভার থেকে ঢাকায়) ভাড়া লাগতো ১ হাজার টাকা। এখন সেই ট্রাকের ভাড়া দিতে হচ্ছে দেড় হাজার টাকা। তবু ট্রাক সংকট।
ফড়িয়া ব্যবসায়ী হাসান মিয়াও গাড়ি ভাড়া দেড় থেকে দ্বিগুণ বৃদ্ধির কথা জানালেন। নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার কলাগাছিয়া এলাকার এই ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, তিনি মূলত শসার ব্যবসা করছেন এখন।
সিরাজগঞ্জের বারোহাস বাজার থেকে শসা কিনে এনে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করছেন হাসান। পাঠান তার ভাই। স্বাভাবিক সময়ে
সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আনার জন্য প্রতি বস্তার (৯০ কেজি) ট্রাক ভাড়া দিতে হতো একশ’ টাকা। অর্থাৎ কেজি প্রতি এক টাকা দশ পয়সার মতো। এখন দিতে হচ্ছে বস্তা প্রতি দেড়শ’ টাকা।
হরতালের আগে বড় ট্রাক ভাড়া নিতো ১৩ হাজার টাকা। সেই ট্রাকের জন্য এখন ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। তার ওপরে রয়েছে নানা রকম অনিশ্চয়তা আর শঙ্কা।
এই ব্যবসায়ীর মোট মূলধন ছিল ৩ লাখ টাকা। টানা হরতাল-অবরোধে লোকসান দিতে দিতে সেই মূলধন কমে গেছে ৬০ হাজার টাকা।
হেমায়েতপুর দক্ষিণ মেডকে গ্রামের বাসিন্দা আশিক জানান ভয়াবহ কাহিনী। এই ব্যবসায়ী ক্ষেতেই শালগম কিনেছিলেন ১০ লাখ টাকার। মুনাফা দূরের কথা, তার লোকসানই হয়েছে ৩ লাখ টাকা।
কৃষক আফসার উদ্দিন জানান, সাভারকে ঢাকাবাসী মনে করে শিল্প এলাকা। কিন্তু এর বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে শাক-সবজি ক্ষেত। বর্ষায় পানিতে তলিয়ে যায় এমন কিছু জমিতে ধান চাষ হয়। এছাড়া সব জমিতেই সারা বছর থাকে বিভিন্ন ধরনের সবজি।
বিকেলে শাক-সবজি তুলে সন্ধ্যায় রাজধানীর বাজারগুলোতে সরবরাহ দিচ্ছেন এসব এলাকার চাষিরা। স্বল্প সময়ে ঢাকায় পৌঁছানোর কারণে সবজি থাকে টাটকা। যে কারণে ক্রেতাদের কাছে সব সময়ই চাহিদা থাকে অনেক বেশি।
এ চাহিদার কারণে সাভারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সবজি চাষ। বেড়ে গেছে জমির ইজারা মূল্যও। ১ পাকি (২৬ শতক) ১৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা, অপেক্ষাকৃত নিচু জমি বছরে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
সাভারের চাকুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহ আলম বাংলানিউজকে জানান, বাঁধাকপিতে লোকসান গেলেও ফুলকপিতে কিছুটা মুনাফার আশা করছেন তিনি। দেড় বিঘা জমিতে ৫ হাজার ফুলকপি লাগিয়েছিলেন।
এতে তার খরচ হয়েছে প্রায় বাইশ হাজার টাকা। জমির ইজারা বাবদ দিতে হয়েছে ১০ হাজার টাকা। আশা করছেন ১৫ হাজার টাকা মুনাফা হবে তার।
কি কৃষক আর কি ব্যবসায়ী- বাজারে থাকা সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। কান খাঁড়া, কোথাও সামান্য শব্দ হলেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন কি-না সেই আতঙ্কে সময় কাটছে তাদের।
পিকআপ চালক আব্দুল কাদের সাভার থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করেন। বিষন্ন মুখে জানালেন, বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মনে হয়, এই বুঝি শেষ যাওয়া। হয়তো লাশ হয়ে ফিরতে হতে পারে। এভাবে কোনো দেশ চলতে পারে?’
এতো ভয় নিয়ে বের হন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, কি করুম। বউ-বাচ্চা নিয়ে বাঁচতে হইবো তো। পেটতো আর হরতাল-অবরোধ মানবো না। জীবন হাতে করে লইয়াই বাইর হইছি।
খেটে খাওয়া এই মানুষগুলো শান্তি চান। চান কাজ শেষে নিরাপদে বাড়ি ফেরার গ্যারান্টি ।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৫
** জরুরি সবজিবাহী সংবাদপত্রের গাড়ি!