ঢাকা: কারওয়ানবাজারে হরতাল-অবরোধের চেইন ইমপ্যাক্ট পড়েছে। এখানে ট্রাক আসছে না ফলে অলস সময় কাটছে ভ্যানচালকদের।
শনিবার মধ্যরাত। ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুঁই ছুই। ১০/১২ জন তরুণ ভ্যানগাড়ির ওপর বসে তুমুল আড্ডা দিচ্ছিলো। শনিবার সন্ধ্যার পর বগুড়ায় ট্রাকে বোমা পড়ার খবরটিই তাদের আলোচনার বিষয়। ‘এমনে বোমা পড়লে ড্রাইভাররা আর ট্রাক চালাইতো না, তখন আমাগো আর ভাত খাওয়া লাগতো না’ খেদ ঝড়ানো উক্তি একজনের।
সায় দিতে দেরি করেননি বাকিদের কেউই।
এরা সবাই কারওয়ানবাজারের ভ্যানচালক। এই গ্রুপটিতে কারো বয়সই ২৫’র উপরে হবে না। হৈ-হল্লা করেই আড্ডা দিচ্ছিলেন। কিন্তু ভেতরে তাদের পেটে ভাত জোটা না জোটা নিয়েই শঙ্কা।
কাছে এগিয়ে যেতেই মিডিয়া কর্মী বুঝে ফেলেন কয়েকজন। তাদের মনের কষ্ট, ক্ষোভ সব ঝাড়ার এই সুযোগ। সবাই সমস্বরে বললেন, ‘আমাগো কথা একটু লেখেন। আইজকা এক মাসের বেশি হইলো। এই হরতাল অবরোধ আর কতদিন চলবে?’
ভ্যান চালকরাই জানালেন, কারওয়ানবাজারে রাত ১২টার এমন চিত্র তারা তাদের বয়সে আর দেখেন নাই। সানাউলের ক্ষোভটা যেনো সবচেয়ে বেশি। বিকেল তিনটায় কালিগঞ্জ থেকে এসেছেন কারওয়ানবাজার। রাত ১২টা পর্যন্ত তার ট্রিপ হয়েছে মাত্র একটা। সারা রাত কাজ করে দুই থেকে আড়াইশ টাকাও রোজগার হবে না, এমনই আশঙ্কা তার।
রফিক এগিয়ে এসে বললেন, এই যে রাইত ১২টায় কাওরানবাজারের এমন চিত্র কেউ দেখে নাই। মাত্র একটি ট্রাক থেকে মালামাল নামছিলো। বাকিটা ফাঁকা। বললেন, এমন সময় শত শত ট্রাক জমে যাওয়ার কথা। প্রতিদিন ব্যাপারিরা ভ্যান পাইতো না, এখন ভ্যানওয়ালা কাজ পায় না।
কারওয়ানবাজারে এমন শ’ তিনেক ভ্যানচালক রয়েছেন। এদের প্রত্যেকের আয় স্বাভাবিক সময়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। যা এখন ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় নেমে এসেছে।
একটু দূরে যে ট্রাক থেকে মালামাল নামছিলো সেখানে ট্রাক চালক আশিকুর জানালেন প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে এখানে থেমে ওখানে আটকে থেকে একট্রাক মাল তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। এই ট্রাকে সিম আর বরবটি এসেছে। আশিকুরের ট্রাকের সামনের কাঁচে ইট পড়েছিলো। তবে সেটি সপ্তাহখানেক আগে। বগুড়ার বনানী এলাকায় হরতাল অবরোধকারী চালককে লক্ষ্য করে আস্ত ইট ছোঁড়ে। আশিকুর জানালেন, ডাবল পরতের কাচ হওয়াতেই রক্ষা পেয়েছেন। তারপরেও ট্রিপ দিচ্ছেন। ¯্রফে পেটের তাগিদে।
উত্তরবঙ্গ থেকে আসার পথে বগুড়া, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ি এলাকাকে বেশি বিপজ্জনক মনে করেন ট্রাক চালকরা। অন্যদিকে চট্টগ্রাম থেকে মিরসরাই, ফেনী, চৌদ্দগ্রাম এসব এলাকায় বেশি ভয় তাদের।
ঠিক এমন সময় একটি ট্রাক ঢুকলো কারওয়ানবাজারে। আড্ডাবাজ ভ্যানচালকরা নিমিষেই সচল। একটা ট্রাকের পেছনে অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে ছুটছে কয়েক ডজন ভ্যান চালক। কাজ পাবেন হয়তো ৮ থেকে ১০ জন। কিন্তু তাতে কি চেষ্টাতো করতেই হবে। রাতের আয় নিশ্চিত করতেই তাদের এই ঝুকি আর লড়াই। ১০টি ভ্যান কাজ পেলো বাকিরা আবার গিয়ে আড্ডায় জমলো।
এই ট্রাকটিও এসেছে চট্টগ্রাম থেকে। ৬ ঘণ্টার ট্রিপ ১০ ঘণ্টায় নিলে এলাম, বললেন চালক আবুবকর সিদ্দিক। জানালেন ট্রাকের উপরের দিকে সবজি আনলেও, ভেতরে ১৩ টন রড আছে। যা যাবে বগুড়া। পথেই মোবাইল ফোনে জেনেছেন মাঝিরায় পেট্রোল বোমা পড়েছে ট্রাকে। তিনজন মারা গেছে। এতে আবুবকরের ভয় ধরে গেছে। জানালেন রাতে ঢাকার বাইরে বের হয়ে ট্রাক থামিয়ে রাখবেন। সকালে রওয়ানা হবেন বগুড়ার পথে। বললেন, দিনে তবু দেখা যায়। রাতে তো কিছুই বোঝা যায় না।
এতো ভয়ের মধ্যেও লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে ফেললেন আবুবকর। বললেন একদিনের কাজ এখন দুই দিনে করতে হলো। তবে পাশে থেকে ব্যবসায়ী শফিউল আলম বললেন, তোমাদের আর কি তোমরাতো ৪ হাজারের ভাড়া ৯ হাজার নিচ্ছো। এ নিয়ে অবশ্য হালকা ঝগড়াও হয়ে গেলো দুজনের মধ্যে।
ট্রাক না আসলে ভ্যান অচল। ভ্যানে করে মালামাল যে আড়তে যায় সেখানেও নেই কারওয়ানবাজারের স্বাভাবিক অবস্থা।
যাদেরও পণ্য পৌঁছেছে তারাও হতাশ। আলু কিংবা গাজর শসার পাইকাররা জানালেন, মালামাল ঠিক মতো না পৌঁছালে কিভাবে লাভ হবে। গত একমাস ধরে কেবল ক্ষতির মুখই দেখছেন তারা।
গাজরের ফরিয়া মো. সোলাইমান জানালেন দিনে তার ক্ষতি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। মাল আসে না।
কিন্তু আড়তের ভাড়াতো গুনতেই হচ্ছে। সেটাও একটা প্রতিদিনকার ক্ষতি।
হাতে বিশাল ঝাঁকা নিয়ে দাঁড়িয়ে কারওয়ানবাজারের মিন্তি আবদুর রহিম। জানালেন প্রতিরাতে ৫০০ টাকা আয় হতো এখন ২০০ টাকাও হয় না। কারওয়ানবাজারের হাজার খানেক মিন্তির হিসেবেই দিনে ক্ষতি তিন লাখ টাকা।
পলিপ্যাকের আরিফ জানালেন প্রতিদিন গড়ে ২৫০ পাউন্ড পলিপ্যাক বিক্রি হতো। এখন ১০০ পাউন্ডও হয় না। সারা রাতে তার আয় ৫০০ টাকা তোলাই দায় হয়ে পড়েছে। দোকানের ভাড়া দিলে আর কিছুই থাকে না।
চায়ের দোকানদার মোজাম্মেলের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। নিয়মিত দোকানে ২০ হাজার টাকার বেচা কেনা হতো। এখন তা ৮ হাজারও হয় না। সারা রাতের আয় ৫০০-৭০০টাকা হতে পারে। দুই ভাইয়ের দোকান। আলাদা সংসার। কিভাবে চলবে জানা নেই মোজাম্মেলের। কারওয়ানবাজারের ২০০ চায়ের দোকানের প্রত্যেকেরই একই চিত্র।
আর যে ডাবরি-বুটওয়ালা ওবায়েদ তারও দিনের আয় অর্ধেকে নেমেছে। দিনে ২০০ টাকাই আয় করা যাচ্ছে না।
এতো ছোট ছোট কাজের ছোট ছোট ব্যবসার ক্ষতি। এই কারওয়ানবাজারে ব্যবসায়ীদের কোটি টাকার লগ্নি চলে হরদম। তাদের ক্ষতিও কোটি টাকায়।
একটা সহজ হিসাব কারওয়ান বাজারের প্রতিটি ব্যবসায়ী, শ্রমিকের আয় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।
যার মোট ক্ষতি হিসাব কষলে প্রতিরাতে কয়েকশ’ কোটি টাকা হবে বলেই মত অভিজ্ঞ চা দোকানি মোজাম্মেলের।
বিশেষজ্ঞের মত হয়তো পাওয়াই যেতো কিন্তু ২৫ বছরের অভিজ্ঞতার একজন মোজাম্মেলের কথাও উপেক্ষা করার মতো নয়।
বাংলাদেশ সময় ১০১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৫
** ‘মোবিন ফিরত আইলে কথা অবে’
** সিলেটে পর্যটন শিল্পে ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা
** জনগণের চিন্তা কেউ করে না
** হরতাল-অবরোধে খাঁ খাঁ খাতুনগঞ্জ
** চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস এক চতুর্থাংশে নেমেছে
** প্রাণহীন কাঁচাবাজার
** সাভারেই সচল ঢাকা
** জরুরি সবজিবাহী সংবাদপত্রের গাড়ি!
** রাস্তায় জীবনের শঙ্কা, পুলিশের চাঁদাবাজি
** ফল-ফলাদি আসে কম দামও কম
** বের হলে মরি, ঘরে থাকলে মাথায় বাড়ি