রাজশাহী: বড় মেয়ে তাজমিরার বিয়ের সময় একটি এনজিও থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন ট্রাক হেলপার শহীদুল ইসলাম বিশু। একদিকে সংসারের অভাব-অনটন।
টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে হার মানেন শহীদুল। পরিবারের সদস্যদের অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে সোমবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে চলে যান না ফেরার দেশে। পরিবারের একমাত্র রোজগারের মানুষটির এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে ঘোর অনামিশার অন্ধকার নেমে এসেছে পরিবারটিতে।
শোকের বিলাপ ভুলে নির্বাক, স্তব্ধ হয়ে পড়েছে স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের প্রতিটি সদস্য। পাশে গিয়ে দাঁড়ালেও তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছেন না স্বজন ও প্রতিবেশিরা।
পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শহীদুলের মরদেহ সোমবার রাতে তার রাজশাহীর পবা উপজেলার মোল্লাডাইংপাড়া গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার পর পরিবারের সদস্যের আহাজারি যেন আকাশ-বাতাস ভারি করে তুলছিল। তার অকাল মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না পরিবারটি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার নবম শ্রেণি পড়–য়া ছেলে হৃদয়ের প্রশ্ন, কি অপরাধ ছিল তার বাবার। কাজ করতে গিয়ে কেন তাকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো। সে এখন কোথায় বাবা পাবে। যে বাবা নিজে শতকষ্টের মধ্যে থেকেও হাসি মুখে বই-খাতা কিনে দিয়েছেন। দিন-রাত এক করে দিয়ে তার লেখা-পড়ার খরচ যুগিয়েছে। পরিবারের মুখে তিন বেলা আহার তুলে দিয়েছে। কে যোগাবে, কে?
না, তার এমন অসংখ্য প্রশ্নের একটির উত্তর নেই কারও মুখে। নেই সান্ত্বনা জানানোর ভাষাও। বাড়িভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে শহীদুলের মরদেহ দেখার জন্য। কিন্তু ওই পরিবারটির এখন কী হবে তা কারও জানা নেই। সহিংস রাজনীতির শিকার হয়ে তাই পরিবারটি এখন নির্বাক, স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।
শহীদুলের স্ত্রী মানসুরা বেগম জানালেন, বড় মেয়ে তাজমিরার বিয়ে দিয়েছেন কিছুদিন আগেই। ছেলে হৃদয় ও ছোট মেয়ে নিশা খাতুনকে নিয়ে নুন আনতে পানতা ফুরোয় অবস্থায় অনেক টানাটানির মধ্যে চলছিল তাদের সংসার। স্বামীই ছিল এই পরিবারের একমাত্র রোজগারের ব্যক্তি। তিনি আজ আর নেই। ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে তাই চোখের সামনে অন্ধকার দেখছেন মানসুরা বেগম।
নিহত শহীদুলের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার পর তার বাড়িতে যান রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। নিহতের পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভব সকল ধরণের সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আখতার জাহান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
হৃদয় জানায়, মঙ্গলবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় শহীদুলে জানাযার নামাজ পবার মোল্লাডাইং পাড়া জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। পরে স্থানীয় গোরস্থানেই তাকে দাফন করা হবে।
বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান হৃদয়।
এর আগে, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সোমবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেল পৌনে ৫টার দিকে হার মানেন ট্রাক হেলপার শহীদুল (৩৮)।
গত ২ ফেব্রুয়ারি রাজপাড়া থানার মোল্লাপাড়া লিলি সিনেমা হলের সামনে অবরোধকারীদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। পেট্রোল বোমায় তার শরীরের ২৫ শতাংশ পুড়ে যায়। এ ক’দিন রামেকের বার্ন ইউনিটেই চিকিৎসা চলছিল তার। শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ায় তাকে বাঁচানো যায়নি।
ওই ঘটনায় দগ্ধ হয়ে এখনও বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন ট্রাকের চালক পবা উপজেলার আলীগঞ্জ এলাকার সাইদুর রহমান। পেট্রোলবোমার আঘাতে সাইদুর রহমানের দুই হাত, মুখ ও পায়ের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। তবে তিনি বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫