ঢাকা, শুক্রবার, ৩ মাঘ ১৪৩১, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

কুষ্টিয়ায় মায়ের কবরের পাশে সমাহিত হবেন বাদশা (ভিডিও)

সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫
কুষ্টিয়ায় মায়ের কবরের পাশে সমাহিত হবেন বাদশা (ভিডিও) আমিনুল হক বাদশা

লন্ডন: চলে গেলেন সাংবাদিক আমিনুল হক বাদশা। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম এই সাক্ষী ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সোমবার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টায় (বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৫টা) গ্রেটার লন্ডনের অরপিংটন হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন এই অরপিংটন হাসপাতালই ছিল তার শেষ অবস্থানস্থল। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৭১ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, লন্ডনপ্রবাসী এই প্রখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন। ১৯৭৩ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যে বঙ্গবন্ধু আমিনুল হক বাদশাকে লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন। লন্ডনে বসবাসের খরচ জোগানোর জন্যে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুরই নির্দেশে একটি ব্যাংকের (সম্ভবত উত্তরা বা পূবালী) পাবলিক রিলেশন্স অফিসার, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার(বাসস)লন্ডন প্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘প্রবাসী’র সম্পাদক হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার লক্ষ্যে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে যাবার সময় বঙ্গবন্ধু আমিনুল হক বাদশাকে একই বিমানে সঙ্গে করে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্স নামার পর বাদশা একই বিমানে এসে পা রাখেন লন্ডনে। এসময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে আরেক কিংবদন্তি সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীও জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশ নেন।

বাঙালির ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় ৬২র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রয়াত বাদশা’র ছিল সক্রিয় উপস্থিতি। আর তাই যখনই এসব ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা হয়েছে, তখনই বাদশা ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে গর্জে উঠেছেন সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। প্রবীণ এই সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু-পরিবারের একজন সদস্যের মতই ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রোসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুকে কর্ডন করে যেসব ছাত্রনেতা মঞ্চে ছিলেন তাদেরই একজন ছিলেন আমিনুল হক বাদশা। জাতির জনকের স্নেহভাজন স্বাধীনতাপূর্ব কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এই সাবেক ছাত্রলীগনেতা বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারিই শুধু নয়, একান্ত আপনজন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সময় লন্ডনে বিভিন্ন সভা সমাবেশ ও আড্ডায় বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন এই প্রবীণ সাংবাদিক। সতীর্থ সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায় ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা’’-- ৭ই মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই বিশ্বসেরা ভাষণের এই অংশটুকু নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন বাদশা; তাঁর জীবনের সেই সেরা সময়গুলো নিয়ে গর্বিত আমিনুল হক বাদশা বিভিন্ন সময় বাংলানিউজ প্রতিবেদকের কাছেও এ বিষয়ে করেছেন অনেক গল্প।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বাংলানিউজের কাছেই আমিনুল হক বাদশা তার শেষ সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। এরপর আর কোনো সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ হয়নি সদ্যপ্রয়াত এই সাংবাদিকের। মুক্তিবাহিনীর উপ-সেনাপতি মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনির ডেপুটি চিফ অব স্টাফ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারের সদ্য প্রকাশিত  ‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’ বইতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে নতুন বিতর্ক উস্কে দিলে ঐ ইতিহাসের অংশ আমিনুল হক বাদশার মুখে পুরোনো সেই স্মৃতিচারণ আবারও নতুন করে জানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এজন্য যখন তাঁর খোঁজ পড়ল তখন জানা গেল জনাব বাদশা গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই লন্ডনের প্রিন্স রয়েল হাসপাতালে শয্যাশায়ী তিনি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক দুপুরে হাসপাতালের বেডে তাকে দেখতে গেলে বাংলানিউজের কাছে কিছু কথা বলেন আমিনুল হক বাদশা।

তাকে তার নাম ধরে ডাক দিলে প্রথমে কোনোই সাড়া নেই; কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে সামনে এই প্রতিবেদককে দেখে সেই পরিচিত হাসি উপহার দিলেন দিলখোলা এই সাংবাদিক। এরপর আবারও চোখ বন্ধ। কিছুক্ষণ পর আবারও চোখ খুললে কিছুটা ভালোভাবেই কয়েক সেকেন্ড কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সাথে। তাঁকে জানানো হয়, একে খন্দকারের ইতিহাস বিকৃতির সাম্প্রতিক অপচেষ্টার কথা। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণের পর কি ‘জয়বাংলা’ বলেছিলেন? এমন প্রশ্ন করলে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাবই দেন তিনি।

‘‘আপনি কি ঐ সময় সেখানে ছিলেন?’’-- এমন প্রশ্ন করতেই জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে থাকা প্রবীণ এই সাংবাদিকের তেজোদীপ্ত জবাব: ‘অফকোর্স ছিলাম! অফকোর্স ছিলাম!!’। এরপর আরো অনেক কিছু বলতে চাইলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ এই সাংবাদিক। কিন্তু কিছুই বোঝা গেলো না, কথা অস্পষ্ট হয়ে গেলো, খেই হারিয়ে ফেললেন। এরপর দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পরও বাদশা আর চোখ খোলেন নি সেদিন।

কুষ্টিয়ায় মায়ের কবরের পাশে সমাহিত হবেন আমিনুল হক বাদশা 
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আমিনুল হক বাদশা’র মরদেহ দাফন করা হবে কুষ্টিয়ায় মায়ের কবরের পাশে। শেষকৃত্য নিয়ে প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বার্তা পাঠিয়ে পরামর্শ চেয়েছেন। শোককাতর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আপন ছোটভাইয়ের মত বাদশাকে স্নেহ করেছি, শাসন করেছি, ধমক দিয়েছি, আজ খুব করে এসব মনে পড়ছে’’।

তিনি বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর এত স্নেহের ছিলো সে, যে কারণে নিজে উদ্যোগ নিয়ে ব্যারিস্টারি পড়াতে তাকে আলজিরিয়া যাওয়ার পথে সঙ্গে করে নিয়ে যান।

গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা—এই তিন বিষয়ে বাদশা ছিল আপসহীন। তাঁকে হারিয়ে নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছে’’।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমিনুল হক বাদশা’র শেষকৃত্য সম্পন্ন হোক এমনটা আশা করেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তবে নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্যে বাদশা’র মরদেহের সঙ্গে দেশে যেতে পারবেন না বলে জানান তিনি।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, প্রয়াত বাদশার মরদেহ হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঙ্গলবার বিকেল নাগাদই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করার কথা।

মঙ্গলবারের মধ্যে হাসপাতাল থেকে মরদেহ রিলিজ করা হলে কাল বুধবার স্থানীয় সময় বাদ জোহর পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন জামে মসজিদে প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।   পরে কুষ্টিয়ায় মায়ের কবরের পাশে দাফনের জন্য মরদেহ দেশে পাঠানো হবে।



বাংলাদেশ সময়: ২২২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।