ঢাকা: দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রকাশিত হলো ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়। আর আইন অনুসারে চূড়ান্ত রায় প্রদানকারী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে সে রায় পৌঁছেও গেছে বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
এর মধ্য দিয়ে ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো।
তবে ফাঁসি কার্যকর হয়ে যাওয়া জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধেও রিভিউ করার সুযোগ দেন আপিল বিভাগ। সে হিসেবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন করতে ১৫ দিন সময় পাবেনকামারুজ্জামান।
যদি আসামিপক্ষ এ সময়ের মধ্যে রিভিউ আবেদন না করেন তাহলে নিয়ম অনুযায়ী আপিলের রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছানোর পর ট্রাইব্যুনাল আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। বুধবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর একটা ৫৫ মিনিটে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশের ছয় ঘণ্টার মধ্যে রাত পৌনে আটটার দিকে সে রায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালে।
এর আগে বেলা সাড়ে বারোটার দিকে চার বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর দেওয়া শেষ করেন। এটিও রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বিচারপতিদের রায়ে স্বাক্ষর দেওয়া শেষ হওয়ার সময় থেকেই রিভিউয়ের ১৫ দিনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে গেছে।
ট্রাইব্যুনালের মৃত্যু পরোয়ানা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে পড়ে শোনাবেন। এরপর আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না অথবা রিভিউ আবেদন করবেন কি-না তা আসামির কাছে জানতে চাওয়া হবে।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারবেন। ক্ষমা না চাইলে ফাঁসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকবে না।
যদি রিভিউ করেন তাহলে তার জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন আসামিপক্ষ। রিভিউ নিষ্পত্তির পর নিয়ম অনুযায়ী বাকি কাজ সম্পন্ন হবে।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি(বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ এ রায় দিয়েছেন। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, কামারুজ্জামানের মামলার ব্যাপারে আমাদের এতোদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। রায় পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল আসামির মৃত্যু পরোয়ানা জেলে পাঠালে যেকোনো দিন মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করতে পারবে সরকার।
তবে আসামিপক্ষ রিভিউ করলে মৃত্যু পরোয়ানার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যাবে বলেও জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
মাহবুবে আলম আরো বলেন, রিভিউয়ের ১৫ দিনের হিসাব আজ (বুধবার) থেকেই শুরু হবে। এই ১৫ দিন রাষ্ট্রকে অপেক্ষা করতে হবে কি-না তা আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার রিভিউয়ের রায়ে বলেননি। তবে রিভিউ আবেদন দায়ের করলে দণ্ডাদেশের কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যাবে।
গত বছরের ৩ নভেম্বর সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রিভিউ আবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় তারা পাবেনই। কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবালও জানিয়েছিলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করা হবে।
আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী শিশির মো. মুনির বুধবার বাংলানিউজকে বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর আমরা ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করবো।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন কামারুজ্জামান। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে এই বাহিনী ওই অঞ্চলজুড়ে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে এ ধরনের মোট ৭টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগগুলোর মধ্যে সোহাগপুর গণহত্যার (৩ নম্বর) অভিযোগটিতে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের (৩:১) ভিত্তিতে ওই রায় বহাল রাখেন বিচারপতিরা। তাদের মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখলেও বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন।
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার (৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এ অভিযোগে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইবুন্যাল।
অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতন (২ নম্বর অভিযোগ) ও দারাসহ ছয় হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যথাক্রমে ১০ বছর ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
তবে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান হত্যার (১ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন কামারুজ্জামান।
এছাড়া ৫ নম্বর (১০ জনকে হত্যা) ও ৬ নম্বর অভিযোগে (টুনু হত্যা ও জাহাঙ্গীরকে নির্যাতন) আপিল মামলার রায়েও খালাস পেয়েছেন কামারুজ্জামান। ট্রাইব্যুনালও থেকেও এ দুই অভিযোগে খালাস দেওয়া হয়েছিলো তাকে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫
** কাদের মোল্লার চেয়েও ভয়ঙ্কর কামারুজ্জামান!
** কামারুজ্জামানের রায় ট্রাইব্যুনালে
** কামারুজ্জামানের ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
** কামারুজ্জামানের ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায়ে চার বিচারপতির স্বাক্ষর