ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

৬৩ বছরেও শনাক্ত হয়নি শহীদ সালামের কবর

সোলায়মান হাজারী ডালিম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
৬৩ বছরেও শনাক্ত হয়নি শহীদ সালামের কবর

ফেনী: মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বিশ্ব দরবারে ইতিহাস গড়েছে বাঙালি জাতি। এ অর্জন বাঙালির শতাব্দীকালের অর্জন হলেও যারা লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের ব্যাপারে অবহেলা যেন দিনে দিনে বাড়ছে।

অবহেলারই উদাহরণ হিসেবে দীর্ঘ ৬৩ বছরেও ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া আবদুস সালামের কবর শনাক্ত করা যায়নি।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বায়ান্ন’র উত্তাল সময়ে চলমান আন্দোলন টগবগে তরুণ সালামের হৃদয়ও ছুঁয়ে যায়। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ১৪৪ ধারা জারি করলেও তা অগ্রাহ্য করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিলে নামে ছাত্র-জনতা। সে মিছিলে অদম্য সাহসে অংশগ্রহণ করেন সালামও।

আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে পড়লে মিছিলে পুলিশ নির্বাচারে গুলি চালায়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ গুলিবিদ্ধ হন অনেকে।

গুরুতর আহতাস্থায় আবদুস সালামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ফেনীর গর্বের সন্তান। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে সালামের মৃতদেহ ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়।

ওই প্রাচীন কবরস্থানে হাজারো কবরের ভিড়ে মহান ভাষা শহীদ আবদুস সালামও চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। কিন্তু অনাগ্রহ-অবহেলায় ৬৩ বছরেও তার কবরটি চিহ্নিত করা যায়নি।

স্বজন-পরিবার ও সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য দাগনভূঞার সালাম নগর গ্রামে সালাম জাদুঘর ও পাঠাগার নির্মাণ করেছে সরকার। কিন্তু সেই জাদুঘরটিতে যেতে যে রাস্তা রয়েছে তা নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চলাফেরা করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাদুঘরে সালামের একটি পোস্টার (ছবি) ছাড়া নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন। একজন গ্রন্থাগারিক নিয়োগ দেওয়া হলেও নিয়মিত গ্রন্থাগারটি না খোলার অভিযোগ করেছেন স্থানীয় লোকজন। গ্রন্থাগারে পড়ার জন্য রাখা হয়নি কোনো ধরনের স্থানীয় বা জাতীয় পত্রিকাও।

জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ফেনী শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের লক্ষ্মণপুর গ্রামে (বর্তমান সালাম নগর) সালামের পৈতৃক বাড়ির অদূরে এডিপির অর্থায়নে এলজিইডির অধীনে ১২ শতক জমির ওপর প্রায় ৬৩ লাখ পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয়ে জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি নির্মাণ করা হয়।

২০০৮ সালের ২৬ মে স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

উদ্বোধনের সময় পাঁচ হাজার মূল্যবান বই গ্রন্থাগারের জন্য দেওয়া হয়। উদ্বোধনের সাত বছর পরেও কোনো গ্রন্থাগারিক ও তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেওয়া না হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালি শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০১১ সালের (১৩ ফেব্রুয়ারি) শহীদ সালামের ছোট ভাইয়ের মেয়ে খাদিজা বেগমকে প্রথমে মাসিক চার হাজার, পরবর্তী সময়ে দু’হাজার টাকা বাড়িয়ে ছয় হাজার টাকা বেতনে গ্রন্থাগারিক পদে চাকুরি দেওয়া হয়।

তার তত্ত্বাবধানে বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত গ্রন্থাগার পাঠকদের পড়ার জন্য খোলা থাকে।

গ্রন্থাগারটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্যও দাবি জানিয়েছেন শহীদের পরিবার ও সংশ্লিষ্টরা।


এদিকে, দাগনভূঞায় শহীদ সালামের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নামও তার নামে নামকরণের দাবি করেছেন তারা।

সালামের ছোটভাই আবদুল করিম বাংলানিউজকে জানান, সালামের গ্রামের লক্ষ্মণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যদি সালামের নামে নামকরণ করা হয় তাহলেও সালামের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে। আমি সরকারের কাছে স্কুলটিকে সালামের নামে নামকরণ করার জন্য দাবি করছি।

অপরদিকে, ভাষা শহীদ সালামের স্মৃতি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য ফেনী জেলা পরিষদের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে দাবি করছেন জেলা পরিষদ প্রশাসক আজিজ আহম্মদ চৌধুরী।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সালামের স্মৃতি রক্ষা করার জন্য ফেনী শহরে তার নামে একটি কমিউনিটি সেন্টার করেছি, তার গ্রামে একটি জাদুঘর ও একটি লাইব্রেরি করেছি। জেলা পরিষদ সর্বদা সালাম জাদুঘর ও লাইব্রেরির রক্ষণাবেক্ষণ করছে।

আবদুস সালাম ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার তৎকালীন লক্ষ্মণপুর গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া ও মায়ের নাম দৌলতেরনেছা।

সালাম স্থানীয় মাতুভূঞা করিমুল্লাহ জুনিয়র হাই স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। অতঃপর চাকরির সন্ধানে ঢাকায় আসেন। সেসময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগে পিয়ন হিসেবে চাকরি পান এবং নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাস শুরু করেন।

চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আবদুস সালাম ছিলেন সবার বড়। বর্তমানে জীবিত আছেন শহীদ সালামের ছোটভাই আবদুল করিম ও বোন বলকিয়ত নেছা।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।