ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

অমর একুশের সেকাল একাল

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
অমর একুশের সেকাল একাল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: একটি বাগানের মাঝে ছিল আমার জীবনের প্রথম দেখা শহীদ মিনার। সে সময়ে আমাদের পাড়ার ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন আফাজউদ্দিন।

খুব একটা শিক্ষিত না হলেও তার ছিল অসাধারণ সুন্দর একটি মন।

তিনি নিজের হাতে শহীদ মিনারের বাগানের ফুলগাছগুলোর যত্ন নিতেন, খুপরি দিয়ে মাটি নিড়াতেন, পানি ঢালতেন নিয়ম করে। তার কল্যাণেই আমরা পেয়েছিলাম অতি সুন্দর এই শহীদ মিনারটি।

‘ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু’ এই লাইনটি আমার ছোট মনে এঁকে দিতো কষ্টের চিত্রকল্প। বুক ভেঙে দেয়া কান্নারা দলা পাকাতো কণ্ঠনালীতে। একসময়ে ঘুমিয়ে পড়তাম আম্মাকে জড়িয়ে ধরে। আবার আম্মার ডাকেই উঠে যেতাম একুশের কাকভোরে। ’

আগুনঝরা ফাল্গুনে রক্তে নাচনতোলা আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যের দিন অমর একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে উপরের কথাগুলো ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ কাব্যগ্রন্থের লেখক, ময়মনসিংহের কৃতি সন্তান মাহবুবুল হক শাকিলের।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, পেশায় রাজনীতিক এ তরুণ কবি শৈশবের একুশ উদযাপনের দৃশ্যপট বর্ণনা করে নিজের ফেসবুকে আরো দু’বছর আগে এমন তথ্যসম্বলিত একটি নোট লিখেছিলেন। শিরোনাম ‘ছোটবেলার একুশ এবং স্মৃতির ছেঁড়াপাতা’।

ময়মনসিংহের সীমান্তঘেঁষা দূর উপজেলা ধোবাউড়া। এ উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া স্কুলের একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের দৃশ্য। কলাগাছের শহীদ মিনারে শিমুল ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি। নগ্নপদে প্রভাত ফেরি। স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বের হলো মিছিল। শ্লোগান ‘শহীদ দিবস, শহীদ দিবস, অমর হোক, অমর হোক। ’

১৯৮২ সালের সময়কার চিত্রপট হৃদয়ের প্রকোষ্ঠ থেকে তুলে আনেন ওই বিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী। স্মৃতিচারণ করে বলেন, একটা সময় ছিল, যখন গ্রামে শহীদ মিনার ছিল না। ফেব্র“য়ারি এলেই অস্থায়ী শহীদ মিনার বানানো হতো কাঠ কিংবা কলাগাছ দিয়ে।

সবার বুকে থাকতো কালো ফিতা। সেপটিপিন দিয়ে আটকানো। আর এখন গ্রামে গ্রামে শহীদ মিনার। যেখানেই স্কুল সেখানে শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার ঐতিহ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশিষ্ট্য।

রাজা-জমিদারদের তীর্থ ভূমি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা। কলাগাছের মিনারে ফুল দেয়া ছিল সেখানকার ট্র্যাডিশন। সেখানেও এখন শতাধিক স্কুলে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। পরম গৌরবের একুশে ফেব্রুয়ারির রাতে সেখানেও অশ্রুতে সিক্ত হয়েছে শহীদ মিনারের প্রতিটি ফুল।

সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহের টাউন হল চত্বরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। মিনারটি থেকে কয়েক গজ দূরে দেয়ালের পাশে একটি ছোট পিলার রয়েছে। দেড়ফুট পাশ, ৪ ফুট উঁচু। মাঝে গোল বৃত্ত। এটি ঐতিহাসিক। ময়মনসিংহ পৌরসভার পূর্ব পাশে পাঁচ রাস্তার মাথায় স্থাপন করা হয়েছে ‘স্মৃতি অম্লান’ ভাস্কর্য।
সেখানেই ১৯৫৪ সালে স্থাপন করা হয়েছিল প্রথম শহীদ মিনার। কয়েক বছর আগে বিউটিফিকেশনের আওতায় সেই স্থানটিতে অত্যাধুনিক ভাস্কর্য ৫২’র স্মৃতিস্মারক নির্মাণ করে দিয়েছেন ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু।

ময়মনসিংহে ২০ ফেব্রুয়ারি ফুলের বাজার ছিল জমজমাট। অথচ এক সময় তেমনটি ছিল না। শিমুল বা গাঁদা ফুলের মালা গেঁথে আগে হৃদয়ের মিনারে বাহান্নর এ দিনে মায়ের ভাষা বাংলার দাবিতে প্রাণ দেয়া সাহসী সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হতো। সময়ের ঘূর্ণায়মান স্রোতে সেই দিন আর নেই। এখন শহরে ফুলের বাজার জমজমাট।

তবে একটি জায়গায় এখনো মিল রযে গেছে বললেন প্রেসক্লাব ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক মো: শামসুল আলম খান। ‘ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আগেও চত্বর থাকতো আলোকিত। এখনো তাই। আগে মাইকে দেয়া হতো ধারাবিবরণী আর এখন মাইকে সংগঠনের নাম ঘোষণা করা হয়। শহীদ মিনারের চারপাশের দেয়ালে অলংকরণ করা হয়। ’

একুশের প্রথম প্রহর শুরুর আগেই শুক্রবার দিনমান শহরের রাস্তায় রাস্তায় আঁকা হয় আল্পনা। রাত ১১টার পর থেকেই সারা রাত ব্যানার আর ফুল নিয়ে দলে দলে যাত্রা শুরু হয় শহীদ মিনারের দিকে। মধ্যরাতের প্রভাত ফেরি চলে শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ। অনেকে পারিবারিকভাবে শিশুদের নিয়ে, কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে আসেন শহীদ মিনারে ফুল দিতে।

বাতাসে তখনও ভেসে আসে সেই কালজয়ী সঙ্গীত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি..। ’ সুরের মূর্চ্ছনায় মনপ্রাণ উজাড় করে তুলে ধরা হয় জাতির বীর সন্তানদের বীরত্বগাঁথার অমর-অব্যয় ইতিহাস।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।