ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

স্বপ্নকে অধরা রেখেই চলে গেলো স্বপ্না!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
স্বপ্নকে অধরা রেখেই চলে গেলো স্বপ্না!

ঢাকা: আধখোলা চোখে অপলক তাকিয়েই ছিলেন স্বপ্না। হঠাৎ করেই থমকে গেলো রক্তচাপ আর হৃদস্পন্দন! ঝাপসা হয়ে গেলো ভেন্টিলেটরের মনিটর!

একজন এসে চোখটি বুজে দিলেন।

অন্যজন এসে বুক পর্যন্ত থাকা সাদা চাদরটি ঢেকে দিলেন মাথা পর্যন্ত। তারপর কান্নার রব। হু হু করে কেঁদে উঠলেন সবাই। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন স্বজন ও সর্তীথরা।

এ চিত্র শুক্রবার রাতের। সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র জুড়ে তখন শোকাবহ পরিবেশ। সর্তীথদের কেউ কেউ যুদ্ধে হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো দেয়ালে মাথা খুটছেন। কেউ আহাজারিতে স্মরণ করছেন স্বপ্নাকে। খবর শুনে যারা সান্ত্বনা দিতে ক্যাম্পাস থেকে ছুটে এসেছিলেন সেই শিক্ষকরাও আটকে রাখতে পারেননি অশ্রু। চোখ ভেঙ্গে জল গড়াতে দেখা যায় সবার।

টানা সাতদিন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ’র শয্যায় ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়র ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী স্বপ্না খাতুন।

যে ক্যাম্পাস থেকে স্বপ্না এ হাসপাতালে এসেছিলেন শনিবার সকালেই বন্ধুদের সঙ্গে প্রিয় সেই ক্যাম্পাসেই ফিরলেন তিনি। তবে জাহানারা হলে ১১০ নম্বর কক্ষে নয়। একটু দূরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। নিথর দেহে।

স্বপ্নাকে শেষবারের মতো বিদায় জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সাবেক উপাচার্য, বিভাগের প্রধান, ডিন, প্রভোস্টসহ শিক্ষার্থী ও বন্ধুরা।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্বপ্না রওনা দিলেন গ্রামের পথে! প্রায় পৌনে একঘণ্টা অবস্থানের পর ক্যাম্পাস থেকে স্বপ্না রওনা দেন শৈশবের গ্রামে নাটোরের পথে।

সাড়ে নয়টায় শবযাত্রায় স্বপ্নার পেছনে ক্যাম্পাসের দুটি বাস, মাইক্রোবাসে শিক্ষক ও সতীর্থরা।

শব যাত্রা নয় যেন পরিবারের স্বপ্নভঙ্গের যাত্রার পথিক হলেন স্বপ্না।

দুপুর পৌনে ২টায় নাটোরের বড়াইগ্রামে শ্বশুড়বাড়িতে পৌছে যান স্বপ্না। সেখানে তাকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে ছুটে আসেন স্বজনরা। দুটোয় জানাজা শেষে আট কিলোমিটার দূরে স্বপ্নাকে নেয়া হয় জন্ম ও শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত নাটোরের ঢুলিয়া গ্রামে। সেখানে শেষবারের মতো সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্তন্তের পথে যাত্রা শুরু হয় স্বপ্নার। এই গ্রামেই সমাধি হয় তার।

গ্রামের কৃষিমজুর সবের আলী ও মালেকা বেগমের মেয়ে স্বপ্না।

দুই ভাই এক বোনের মধ্যে স্বপ্না সবার ছোট। দুই ভাই তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক। কৃষক পরিবারের মেধাবী মেয়ে স্বপ্নার সঙ্গে বিয়ে হয় বরাইগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাটমুদ্রাক্ষরিক রাফিউর রহমানের।

২০১১ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিয়ের পর মেধাবী স্বপ্না ভর্তি হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে।

একই বছরের ২১ ডিসেম্বর ক্লাস শুরু হয়। স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতীক্ষায় প্রতিটি পরীক্ষায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায় স্বপ্না। প্রথমবর্ষের ফাইনালে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও ছিলো তার অসামান্য অবদান। ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় হল সেরার মুকুট ওঠে তার মাথায়। মেধাবী স্বপ্নাকে ঘিরে এভাবেই সম্ভাবনার আলো দেখতে থাকেন শিক্ষক ও সহপাঠীরা।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে অসুস্থ্য বোধ করে সে। প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ফিরে যায় জাহানারা ইমাম হলের এ ব্লকের ১১০ নম্বর কক্ষে।

পরে বেশ কয়েকটি ওষুধ খেয়ে ঘুমুতে যায় সে। পরদিন চোখে ব্যথা। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রচণ্ড জ্বর। পর দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি বমি নিয়ে তাকে ভর্তি করা হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

তার চিকিৎসার খরচ যোগাতে ঝাপিঁয়ে পড়ে বন্ধু ও সতীর্থরা। তবে সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে টানা সাতদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান স্বপ্না।

এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রেজাউল হক বাংলানিউজকে জানান, প্রাথমিক পরীক্ষার পর আমরা নিশ্চিত হয়েছি, মাত্রাতিরিক্ত ব্যথার ওষুধ সেবনে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় লিভার অকেজো হয়ে পড়েছে স্বপ্নার। আমরা স্বপ্নাকে যে অবস্থায় পেয়েছিলাম সেখান থেকে তার অবস্থার উন্নতি করাটাই ছিলো বাস্তবতার বাইরে।

লিভার ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া এ ধরণের রোগীর জীবন বাঁচানোই কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এতদিন সান্ত্বনা দিয়েই হলের একটি কক্ষে রাখা হয়েছিলো স্বপ্নার মা মালেকা বেগমকে। মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারেন এই ভয়েই মেয়ের প্রকৃত অবস্থা জানানো হয়নি তাকে। তবে মেয়ের মৃত্যুর সংবাদে ভেঙ্গে পড়েন স্বপ্নের জাল বুনে আসা মমতাময়ী মা।

‘তোমরা আমার স্বপ্নাকে ফিরায়া দাও-আমি ওরে ছাড়া কেমনে বাচঁবো’- এভাবেই বিলাপ করছিলেন তিনি।

ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ স্বামী রাফিউর রহমান। বাংলানিউজকে জানান, গত ১৪ ফ্রেরুয়ারি প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে আমি হাসপাতালে যাচ্ছি- এটাই ছিলো স্বপ্নার শেষ কথা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহেদুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, চোখের সামনে একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর এভাবে প্রস্থান কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।

গোটা বিভাগই শোকে মূহ্যমান বলে জানান তিনি।

বিভাগের শিক্ষক আনারুল হক মন্ডল বাংলানিউজকে জানান, সন্তান, সতীর্থ আর স্বজন হাজানোর কান্নায় একাকার স্বপ্নার গ্রাম।

তিনি বলেন, আমরা স্বপ্নার প্রতি আমাদের দায়িত্ব আর ভালোবাসা জানাতেই ওর গ্রামের বাড়িতে এসেছি।

স্বপ্নাকে বাঁচাতে সাহায্যের জন্যে ছুটে বেড়ানো স্বপ্নার বন্ধু আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, আমাদের প্রিয় বন্ধুকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। এটা আমাদের আক্ষেপ। ও সবকিছুকে তুচ্ছ করে এতো তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই পারছি না।

স্বপ্না নেই এটা স্বপ্নে-ও ভাবতে পারছি না।

স্বপ্না হয়তো স্বপ্নেই আসবে। তবে স্বপ্নাকে নিয়ে আর কারো স্বপ্ন দেখা হবে না! এই বাস্তবতাকে মেনেই সবাইকে স্মৃতির জগতে রেখে স্বপ্না এখন অনন্তের পথে।

যে পথে যাওয়াই যায়! ফেরা যায়না কখনোই!

জাবি শিক্ষার্থী স্বপ্নাকে বাচঁতে এগিয়ে আসুন

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।