পাটুরিয়া (মানিকগঞ্জ) থেকে ফিরে: মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ফেরিঘাটের অদূরে পদ্মায় লঞ্চ ডুবির ঘটনায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেলেন লঞ্চমালিক আব্দুর রহিম খান।
এ ঘটনায় কার্গো ও লঞ্চের মাস্টার, সারেং, সুকানির নামে মঙ্গলবার শিবালয় থানায় মামলা হলেও আসামি করা হয়নি লঞ্চমালিক রহিম খানকে।
জানতে চাইলে মামলার বাদী পাটুরিয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল মোকতাদির বাংলানিউজকে বলেন, আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লঞ্চ-কার্গোর মাস্টারসহ অন্যদের আসামি করে মামলা করেছি। তদন্তে মালিকদের নাম আসলে তারাও আসামি হবেন।
অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী, (১৯৭৬) গঠিত নৌআদালত ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স (আইএসও) লঙ্ঘনের অভিযোগে মালিকদের বিরুদ্ধেই মামলা করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়াও নৌদুর্ঘটনার কারণ তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলানিউজকে বলেন, পাটুরিয়ায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় লঞ্চমালিককে আসামি না করে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। কারণ, মালিকই লঞ্চের সব কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। লঞ্চ চলাচলের যোগ্য কিনা, মাস্টারের সনদ আছে কিনা এসব কিছু দেখার দায়িত্ব তার। মালিক দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না। তিনিই আগে আসামি হবেন।
এদিকে, সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই নৌপথে চলাচলকারী ৩৬টি লঞ্চের মধ্যে সাতটির মালিক শিবালয় উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম খান। ২২ ফেব্রুয়ারি বেলা পৌনে ১২টার দিকে ডুবে যাওয়া এম.ভি. মোস্তফা ছাড়াও তার মালিকানাধীন আরো ছয়টি লঞ্চ রয়েছে।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চ ডুবে শতাধিক যাত্রীর মৃত্যুর পরও এম.ভি. সুজন, এম.ভি. বরকত, এম.এল. আরাফাত, এম.ভি. নাবিলা, এম.ভি. শিবালয়, এম.ভি. তাজমহল যাত্রী পারাপার করছে। এসব লঞ্চের হালনাগাদ কোনো কাগজপত্র ও মাস্টারের সনদ না থাকলেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
মঙ্গলবার (২৪ফেব্রুয়ারি) পাটুরিয়া লঞ্চঘাটের পন্টুনে নোঙর করা এম.ভি. তাজমহল লঞ্চে গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনার সময় প্রয়োজনীয় উদ্ধার সরঞ্জামের তালিকায় পাঁচটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও ২৮টি লাইফ সার্পোট জ্যাকেটসহ অন্যান্য উপকরণের নাম লেখা রয়েছে।
লঞ্চের ভেতরে গিয়ে পাওয়া গেল, মাত্র ১৮টি লাইফ সার্পোট জ্যাকেট ও ৪টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র।
জানতে চাইলে গ্রীজার আলমগীর হোসেন জানান, বাকি ১০টি বয়া ও একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র মেরামতে পাঠানো হয়েছে। কতদিন আগে মেরামতে পাঠানো হয়েছে, কবে নাগাদ আনা হবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।
লঞ্চটির হালনাগাদ ফিটনেস ও সার্ভে সনদ ও নিজের লাইসেন্স দেখতে চাইলে এম.ভি. তাজমহলের মাস্টার মো. শরিফুল ইসলাম ব্যস্ত আছেন বলে এড়িয়ে যান।
অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, রহিম খানের মালিকানাধীন একটি লঞ্চেরও ফিটনেস ও সার্ভে সার্টিফিকেট নেই। দুই/একটি যা দেখানো হয়, তা জাল। প্রতিটি লঞ্চে নির্দিষ্ট সারেংয়ের নাম থাকলেও একই সারেং একাধিক লঞ্চ পরিচালনা করেন।
তিনি আরো বলেন, সবগুলো লঞ্চই অদক্ষ সুকানি দিয়ে চালানো হচ্ছে। রোববার দুর্ঘটনা কবলিত লঞ্চ এমভি মোস্তফাও চালানো হচ্ছিল সুকানি নজরুল ইসলামকে দিয়ে। লঞ্চের সারেং ছুটিতে ঢাকায় ছিলেন। বিআইডব্লিউটিএ’র ট্রাফিক ইন্সপেক্টর লঞ্চঘাটের পন্টুনে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করলেও রহস্যজনক কারণে এসব বিষয় পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস পায় না।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক এসএম সাজ্জাদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এই নৌপথে চলাচলকারী ফিটনেস সার্ভে সনদের মেয়াদ শেষ হওয়ায় পাঁচটি লঞ্চের চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তাজমহলের ফিটনেসসহ অন্যান্য সব কাগজপত্র ঠিক আছে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফকরুল ইসলাম বলেন, ঝড়ের সময় এমএল টাইপের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়। তাই, এমএল ক্যাটাগরির লঞ্চকে অল্পস্বল্প জোড়াতালি দিয়ে এমভি ক্যাটাগরির করা হয়। এমএল ক্যাটাগরির লঞ্চ মোস্তফার দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ২৪.৮ মিটার, প্রস্থে ৫.৩০ মিটার এবং উচ্চতা ১.৭০ মিটার দেখিয়ে এমভি করা হয়েছে।
রহিম খান জেলা জাকের পার্টির সাবেক সভাপতি হলেও ক্ষমতাসীন মহাজোটের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আরিচা লঞ্চমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রহিম খান আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আঁতাত রেখে পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন বৈধ-অবৈধ সব ব্যবসা।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫