ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করতে আর সাতদিন সময় হাতে আছে। এর মধ্যে রিভিউ না করলে রায় কার্যকরে আর কোনো বাধা থাকবে না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
বৃহস্পতিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর থেকে রিভিউ করতে ১৫ দিন সময় পাবেন- আসামিপক্ষের আইনজীবীদের এমন দাবির প্রত্যুত্তরে এ কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
তিনি বলেন, কাদের মোল্লার রিভিউ মামলার রায়ে স্পষ্ট করে বলা আছে, আসামি রায় শোনার পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে পারবেন।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আসামিকে পূর্ণাঙ্গ রায় ও মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়েছে। এরপর থেকে গণনা করা হলে আগামী ৫ মার্চ বৃহস্পতিবার ১৫ দিন পূর্ণ হবে।
এদিকে সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর্ থেকে ১৫ দিন গণনা শুরু হবে দাবি করে কামারুজ্জামানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, কাদের মোল্লার রিভিউ মামলার রায়ে রিভিউয়ের ক্ষেত্রে দু’টি অপশন রয়েছে। আসামি পূর্ণাঙ্গ রায় জানার পর অথবা আইনজীবীরা পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করা যাবে বলে সেখানে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন আমরা সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ করে নির্ধারিত সময়ের আগেই আইন অনুযায়ী রিভিউ আবেদন করবো।
বৃহস্পতিবারই কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পেয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান তার আরেক আইনজীবী শিশির মো. মুনির।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারা কর্তৃপক্ষ কামারুজ্জামানকে তার মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনান। এর দু’ঘণ্টা আগে লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানাটির সঙ্গে আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপিও পৌঁছে কারাগারে। সে সময় কামারুজ্জামান জানান, তিনি আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে রিভিউ আবেদনের বিষয়ে জানাবেন।
কামারুজ্জামানের ইচ্ছা অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারি তার ৫ জন আইনজীবী কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি আইনজীবীদের রিভিউ করতে বলেন।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি(বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ এ রায় দেন। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
দুপুর একটা ৫৫ মিনিটে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়। এর আগে বেলা সাড়ে বারোটার দিকে চার বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর দেওয়া শেষ করেন।
রাত পৌনে আটটায় আপিল বিভাগ থেকে ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পৌঁছে দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। একই সঙ্গে পাঠানো হয় ট্রাইব্যুনালের রায় ও অন্যান্য ডকুমেন্টস, যেগুলো আপিল শুনানির জন্য পাঠানো হয়েছিল আপিল বিভাগে।
১৯ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ট্রাইব্যুনাল-২ এর ৩ বিচারপতি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম।
পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আইজিপি (প্রিজন) এর বরাবরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠিয়ে দেন।
কামারুজ্জামান মৃত্যু পরোয়ানা জানার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছিলেন, রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়া বা আসামিকে জ্ঞাত করানোর মধ্যে যেটি আগে হয়, সেদিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ দায়ের করতে হবে। তবে এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়ে কোনো বাধা রিভিউয়ের রায়ে নেই।
তিনি জানান, আসামিপক্ষ যদি এ সময়ের মধ্যে রিভিউ করেন তাহলে ফাঁসি কার্যকর প্রক্রিয়া স্থগিত থাকবে। রিভিউ নিষ্পত্তির পর বা রিভিউ খারিজ হলে এ প্রক্রিয়া ফের শুরু হবে।
এরপর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারবেন। ক্ষমা না চাইলে ফাঁসি কার্যকর করার শেষ ধাপগুলো সম্পন্ন করা হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য অনুসারে রিভিউ করার জন্যে ১৫ দিনের সময়সীমার অষ্টম দিন পার হয়েছে, আর সাতদিন সময় হাতে রয়েছে।
তবে এ মতের বিরোধিতা করে ওই দিনই (১৯ ফেব্রুয়ারি) আপিল মামলায় কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, আসামিপক্ষ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর থেকে ১৫ দিন গণনা শুরু হবে।
তিনি বলেন, আসামিপক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করতে পারবেন। রিভিউ নিষ্পত্তির পর যদি মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে, তাহলে আসামির রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ থাকবে।
গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডার কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
মুক্তিযুদ্ধকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন কামারুজ্জামান। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে এই বাহিনী ওই অঞ্চলজুড়ে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা মোট ৭টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মধ্যে সোহাগপুর গণহত্যার (৩ নম্বর অভিযোগ) দায়ে চূড়ান্তভাবে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার (৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি। এ অভিযোগে ট্রাইবুন্যাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও সাজা কমিয়ে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। দারাসহ ছয় হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন ও অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের (২ নম্বর অভিযোগ) দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া এ সাজাও বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
তবে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান হত্যার (১ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন কামারুজ্জামান। এছাড়া ৫ নম্বর (১০ জনকে হত্যা) ও ৬ নম্বর অভিযোগে (টুনু হত্যা ও জাহাঙ্গীরকে নির্যাতন) ট্রাইব্যুনালের রায়ের সঙ্গে একমত হয়ে আপিল বিভাগও খালাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫
** রিভিউ প্রস্তুতি কামারুজ্জামানের