ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: একজন মুক্তমনা লেখক যার কলম আমৃত্যু সোচ্চার ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে। তাকেই বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হল মুক্তবুদ্ধি চর্চার চারণভূমি খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
লেখক ব্লগার অভিজিৎ রায়ের এ অকাল মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে চারিদিকে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সে ক্ষোভ ছড়িয়ে পরে পুরো বিশ্বব্যাপী। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের খবর।
শুক্রবার সারাদিন ক্ষোভ প্রতিবাদে উত্তাল ছিল পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ছাত্র-শিক্ষক-সংগঠকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ছুটে আসেন প্রতিবাদ জানাতে। টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের প্রতিটি প্রতিকৃতি ঢেকে দেওয়া হয় প্রতিবাদের কালো পতাকা দিয়ে।
সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে দফায় দফায় মিছিল করেছে বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন।
প্রতিবাদী গান, স্লোগানে সারাদিন মুখর ছিল টিএসসি এলাকা।
সন্ধ্যায় প্রতিবাদ-সমাবেশে লোক সমাগম আরও বেড়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতার দাবিতে সোমবার ক্যাম্পাসে ধর্মঘটের আহ্বান করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। সন্ধ্যায় শাহবাগ থেকে মশাল মিছিল করে গণজাগরণ মঞ্চ, আলোর মিছিল করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং প্রতিবাদী মশাল মিছিল করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট।
ছাত্র-শিক্ষক-নাগরিক সমাবেশ:
অভিজিত রায় হত্যা ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে হত্যা চেষ্টার প্রতিবাদে সকাল সাড়ে দশটায় সমাবেশ কর ছাত্র-শিক্ষক-জনতা।
‘আক্রান্ত মুক্তচিন্তা’ ব্যানারে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেন কয়েকশ’ ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক এজেএম শফিউল আলম ভূইয়া, সাংবাদিক কামাল লোহানী, লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রাণা দাশ গুপ্ত, মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির, হামিদা হোসেনসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতারা।
সমাবেশে বক্তারা দাবি করেন, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে যারা হত্যা করেছে, অভিজিৎ রায়কেও হত্যা করেছে একই গোষ্ঠী। প্রকাশ্যে একজন লেখককে এ ভাবে হত্যার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারেনা।
এই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শুধু স্লোগান দিলে হবে না অভিজিতের ওপর আঘাতের প্রতিঘাত আমাদের দিতে হবে।
বইমেলায় লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের সমাবেশ:
বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের তথ্যকেন্দ্রের সামনে প্রকাশক-লেখক-পাঠক ও পেশাজীবীর ব্যানারে হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজিব, অভিজিৎ রায়সহ মুক্তমনা লেখকদের হত্যার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, হুমায়ুন আজাদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদের হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হলে মৌলবাদীরা আর মুক্তবুদ্ধির লেখকদের হত্যা করার সাহস পেত না।
বক্তব্য রাখেন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ।
অন্যদের মধ্যে এ সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. মুহাম্মদ সামাদ, কবি তারিক সুজাত, আসলাম সানী, রফিকউল্লাহ খান, হাবিবুল্লাহ সিরাজীসহ কবি-লেখক-পাঠক ও প্রকাশকরা।
ঢাবি শিক্ষক সমিতির প্রতিবাদ:
অভিজিৎ রায়ের হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। শুক্রবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ ও সাধারণ সম্পাদক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার চারণক্ষেত্র, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গণতন্ত্র চর্চার সূতিকাগার। বিভিন্ন মত-পথের মানুষের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি-ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী মুক্তচিন্তার মানুষকে আঘাত করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনকে বারবার বেছে নিয়েছে।
তারা বলেন, শক্তিশালী-যুক্তিতথ্য নির্ভর লেখনীর বিরুদ্ধে চাপাতি কিংবা পেট্রোলবোমাকে ব্যবহার করছে এই নিষ্ঠুর জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের অস্ত্র হিসেবে।
শিক্ষক সমিতি জানায়, অভিজিৎ রায়কে এমন একটি সময়ে হত্যা করা হলো যখন সপ্তাহ পূর্বে আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২/৩টি লাশ ফেলতে মান্না-খোকার নাশকতার গোপন ফোনালাপ জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। এই নাশকতার ষড়যন্ত্র অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
তারা দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করাসহ হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তি দাবি করেন।
গণজাগরণ মঞ্চের মশাল মিছিল:
অভিজিত হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে সকাল দশটা থেকে শাহবাগে অবস্থান নেয় গণজাগরণ মঞ্চ। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে বের করা হয় একটি বিশাল প্রতিবাদী মিছিল।
মিছিলটি শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে শুরু হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘুরে আবার একই স্থানে এসে শেষ হয়।
মিছিল শেষে মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বাংলানিউজকে বলেন, একের এক হত্যাকান্ড ঘটিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে হত্যাকারীরা। তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না।
বিচারহীনতার এই যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এর ফলেই ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড।
এদিকে সকালে শাহবাগ থেকে ইমরান এইচ সরকার ঘোষণা দেন, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করা পর্যন্ত টানা অবস্থান চলবে।
এসময় হত্যাকারীদের গ্রেফতারে ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটামও দেন তিনি।
প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিল-সমাবেশ ও ধর্মঘট:
বৃহস্পতিবার রাতে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো।
ওইদিন রাতে রাজু ভাস্কর্যর সামনে অবস্থান নিয়ে মিছিল সমাবেশ করেন তারা। এছাড়া শুক্রবার সারাদিন বিভিন্ন প্রতিবাদী গান স্লোগানে মুখর করে রাখেন পুরো টিএসসি এলাকা।
সন্ধ্যায় তারা একটি প্রতিবাদী মশাল মিছিলও বের করেন। এতে অংশ নেন ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতকর্মীরা।
এদিকে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে এবং হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট আহ্বান করেছে তারা।
ছাত্রলীগের আলোর মিছিল
লেখক, ভাষা বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা এবং অভিজিৎ রায়ের হত্যার প্রতিবাদে ঢাবি ক্যাম্পাসে আলোর মিছিল করেছে ঢাবি ছাত্রলীগ।
মুখে কালো কাপড় বেঁধে এবং হাতে জলন্ত মোমবাতি মোমবাতি নিয়ে তারা এ মৌন মিছিল করে।
মিছিলটি টিএসসির পায়রা চত্বর থেকে শুরু হয়ে সড়কদ্বীপ ঘুরে টিএসসি হয়ে পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। ঠিক যে জায়গায় হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয় সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার নেতৃবৃন্দ।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাবি ছাত্রীগের সভাপতি মেহেদী হাসানের সভাপতিত্বে এবং ওমর শরীফেল সঞ্চালনায় একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করা হয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ।
হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায় সহ সকল বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
** অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাবি এলাকা
বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৫