শেরপুর (বগুড়া): সড়কের দু’ধারের গাছের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, একাধিক পাহারাদার। সঙ্গে আনুষঙ্গিক সুবিধাও।
তবু রক্ষা পাচ্ছে না সড়কের পাশের গাছ। একের পর এক এক উজাড় হয়ে যাচ্ছে গাছপালা।
শুধু একটি, দুটি নয়। এভাবে গাছখেঁকোদের পেটে চলে গেছে মহাসড়কের অন্তত ৯ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা অসংখ্য গাছ।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর থেকে বিশালপুর ইউনিয়নের রানীরহাট পর্যন্ত প্রায় ৯ কিমি সড়কের দু’পাশ দিয়ে স্থানীয় বন বিভাগের উদ্যোগে লাগানো গাছগুলো দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই একে একে হারিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে শত শত গাছ কাটা পড়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেলো অবিশ্বাস্যভাবে গাছ নিধনের কাহিনী। প্রথমে মহাসড়কের দুই পাশের চিহ্নিত গাছের ডালপালা কেটে গাছগুলো মেরে ফেলে গাছখেঁকো চক্রের লোকজন।
পরে সুযোগমতো সেসব গাছ কেটে পুরোটাই গায়েব করে দেওয়া হয়। এমনকি মুছে ফেলা হয় গাছ কাটার চিহ্নও।
এভাবেই ভবানীপুর থেকে বিশালপুর ইউনিয়নের রানীরহাট পর্যন্ত সড়কের অসংখ্য শিশু আর রেইনট্রি কড়ি গাছ কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে।
এছাড়া ডালপালা কেটে এ জাতের আরও কয়েক হাজার গাছ মেরে ফেলা হয়েছে একই কায়দায় গায়েবের উদ্দেশে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (২৬ফেব্রুয়ারি) সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সড়কের পাশে গাছগুলো লাগানোর পর থেকেই কোনো রকম পরিচর্যা করা হয়নি। ফলে রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হয়েও অনেক গাছ আপনা-আপনিই মরে যাচ্ছে। আর যথারীতি বন বিভাগের লোকজন এসব মরা গাছ মাটিতে পুঁতে তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন।
স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের দাবি, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই গাছখেঁকোরা এই ৯ কিমি সড়কের দামী কাঠের অসংখ্য গাছ গায়েব করে দিচ্ছে।
এছাড়া এসব গাছ সাবাড়ে হাত রয়েছে খোদ গাছ রক্ষার দায়িত্ব থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই। এমনটাই বাংলানিউজকে জানালেন, ভবানীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মোস্তফা কামাল।
তার অভিযোগ, স্থানীয় বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা ও গাছ পাহারায় নিয়োজিত কিছু ব্যক্তি গোপন যোগসাজশের মাধ্যমে এসব গাছ কেটে নিচ্ছে।
তিনি জানান, গাছগুলো কাটার জন্য বন বিভাগ ৮-৯ বছরের ব্যবধানে দুই দফা গাছের গায়ে নম্বর বসায়। কিন্তু সে গাছগুলো কাটা হয়নি। মূলত নিজ পকেট ভরতেই গাছগুলো পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। পরে সুযোগমত নিজেরাই বিভিন্ন মাধ্যমে এসব গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
বিশালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজাহান আলী সাজা জানান, স্থানীয় বন বিভাগ গাছগুলো লাগিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করে বসে আছে। এসব গাছের সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণে তাদের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ফলে একপ্রকার অযত্ন-অবহেলার সুযোগে এসব গাছের ডালপালা কেটে গাছগুলো মেরে ফেলছে প্রভাবশালী চক্র।
তবে অনেক সময় জমির মালিকরাও জমির লাগোয়া মরা গাছ কেটে নেয়। এটাও আইনত অপরাধ বলে মনে করেন তিনি।
তিনি অভিযোগ করেন, প্রাপ্তবয়স্ক গাছগুলো কাটতে বারবার বন বিভাগের কর্মকর্তাদের তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ফলে চোরেরা গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে, আর বন বিভাগের লোকজন তার ভাগ নিচ্ছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, এই সড়কে লাগানো বেশিরভাগ গাছই শিশু গাছ। মাটি ও আবহাওয়াজনিত সমস্যার কারণে গাছগুলো মরে যাচ্ছে। তবে চুরি করে দু’একটি গাছ গায়েব হচ্ছে বলেও তিনি স্বীকার করেন।
সরেজমিনে আরো দেখা যায়, ভবানীপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর বাজার থেকে বিশালপুর ইউনিয়নের রানীরহাট এলাকা পর্যন্ত এই আঞ্চলিক সড়কের দু’ধার দিয়ে হাজার হাজার শিশু ও রেইনট্রি কড়িগাছ। ভবানীপুর, গোয়াল বিশ্বা, দলিল, দেওড়া, কৃষ্টপুর, তিরাইল, দামুয়া, সারল ও রানীরহাটসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম এ সড়কের পাশ দিয়ে অবস্থিত। সেইসঙ্গে সড়কের উত্তর পাশ ঘেঁষে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে দুটি করাতকল।
সড়কের দুই পাশের এসব গাছের বয়স কত খোঁজ নিয়ে গিয়েও কম হ্যাপা পোহাতে হলো না। সংশ্লিষ্টরা সঠিক তথ্য জানাতে না পারলেও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় আড়াই দুই যুগ আগে এ সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে বন বিভাগের উদ্যোগে এসব গাছ লাগানো হয়। কিন্তু বর্তমানে অব্যাহতভাবে এসব গাছ কাটা পড়ায় এখন সড়কের অনেক জায়গাতেই আগের মতো গাছের সারি চোখে পড়ে না। সড়কের বিভিন্ন অংশ এখন গাছশূন্য অবস্থায় রয়েছে।
এছাড়া অনেক গাছের ডালপালা কেটে ফেলায় গাছগুলো মরে গেছে।
এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলেও পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। চরমপন্থিদের আনাগোনা থাকায় এসব নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় সাধারণ মানুষেরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন মাঝারি মানের ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে বলেন, আপনি শুনে নেন, পরে লিখবেন।
তারা জানান, বিভিন্ন গ্রামের গাছ রক্ষাকারী পাহারাদাররা নিজের প্রয়োজন দেখিয়ে প্রথমে গাছগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ডালপালা কেটে ফেলে। পরে একটি সময় গাছগুলো মরে গেলে তারাই সেসব গাছ কেটে নেয়। এ তথ্য বন বিভাগের লোকজনও জানেন। কিন্তু তারাও বখরা নেয় বলে তাদের এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর উপজেলা সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রেঞ্জ অফিসার মো. আয়নাল হক বাংলানিউজকে জানান, বন বিভাগের পক্ষ থেকে গাছ লাগালেও জেলা পরিষদ, স্থানীয় সরকার (এলজিইডি), ইউনিয়ন পরিষদ ও গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত লোকজন এর অংশীদার।
বন বিভাগের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, গাছগুলোর বয়স মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। তাই গাছগুলো নিয়মানুযায়ী কাটতে একাধিকবার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মালিকানা নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেওয়ায় গাছগুলো কাটা যাচ্ছে না। তবে দ্রুত এসব টুকিটাকি বিরোধ মিটিয়ে ফেলে দ্রুত গাছগুলো কাটার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) ওবাইদুর রহমান জানান, এ আঞ্চলিক সড়কটির মালিক তার অধিদপ্তর হলেও গাছের মালিক স্থানীয় বনবিভাগ। গাছ লাগানো থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণের মূখ্য ভূমিকাও তারাই পালন করে থাকে।
তাই এ বিষয়ে তিনি তেমন কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫