ঢাকা, সোমবার, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১, ১০ মার্চ ২০২৫, ০৯ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

শ্যামনগরে বেপরোয়া হুমায়ুন বাহিনী

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫
শ্যামনগরে বেপরোয়া হুমায়ুন বাহিনী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাতক্ষীরা: ‘সরকারি খাদ্য গুদামের জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ, স্থানীয়দের মাছের ঘের লুট-পাট, নারী কেলেংকারি, প্রতিবাদ করলেই মামলার হুমকি- এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেন না হুমায়ুন কবীর ও তার বাহিনীর সদস্যরা। আর সবই করছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবে।



শুধু বর্তমান সরকারের সময়ে নয়, যখন যে সরকার তখন সেই সরকারের ক্যাডার বনে গিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন শিবিরের চিহ্নিত ক্যাডার হুমায়ুন কবীর। তিনি আগে ছিল জামায়াতের এমপি গাজী নজরুলের সমর্থক। পরে যখন গোলাম রেজা এমপি হয় রাতারাতি ভোল পাল্টে ওই এমপির ডান হাত হয়ে যায়। আবার এখন নতুন এমপি জগলুল হায়দারের কাছের লোক হয়ে গেছেন তিনি!

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মানিকখালী গ্রামের হাজী আবুল হোসেন গাজীর ছেলে হুমায়ুন কবীরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলানিউজের কাছে এভাবেই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন এলাকাবাসী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকাবাসী জানান, তার অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এলাকায় টিকে থাকা যায় না। প্রতিবাদ করলে তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের ধর্ষণের অভিযোগ দিয়ে হয়রানি করতেও সে পিছপা হয় না। আর সব সময়ই এসব কাজে সহযোগিতা করে রাজনৈতিক দলের নেতারা। কারণ তিনি যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের নেতা হয়ে যায়।

এলাকাবাসী আরও জানান, এলাকার চোর-ডাকাতদের নিয়ে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছে হুমায়ুন। তার দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। কিন্তু কেউ কথা বলার সাহস পায় না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি হুমায়ুন কবীর হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে তার বাহিনী দিয়ে স্থানীয় ভেটখালী সরকারি খাদ্যগুদামের জায়গা দখল করে নির্মাণ করেছেন মার্কেট। অভিযোগ, মার্কেটের একটি দোকান দেওয়ার শর্তে তাকে জায়গা দখলে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় রমজাননগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল হক মোড়ল। মার্কেটের নির্মাণ কাজও তদারকি করছেন তিনি।

undefined


নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ভেটখালী বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, সন্ত্রাসী হুমায়ুনের কাজে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন রমজাননগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল হক মোড়ল ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ। এ অবৈধ কাজে যাতে কেউ বাধা দিতে না পারে সে জন্য ফজলুল হক মোড়ল সরাসরি নির্মাণ কাজ তদারকি করে থাকেন এবং মাঝে মধ্যে পুলিশ পাহারাও বসান। সহযোগিতার প্রতিদান হিসেবে ফজলুল হক একটি দোকানও উপহার পেয়েছেন। গোটা বিষয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্প্রতি হুমায়ুন স্থানীয় সাংসদ জগলুল হায়দারকেও একটি দোকান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বলে শোনা যায়। ইতোমধ্যে দোকান বরাদ্দ দিয়ে তিনি কয়েক লাখ টাকা উত্তোলনও এবং কয়েকটি দোকান ভাড়াও দিয়েছেন।

ভেটখালী খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০-৮২ সালে এলএসডি খাদ্যগুদাম নির্মাণের জন্য হুমায়ুন কবীরের বাবা আবুল হোসেন গাজীর কাছ থেকে ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত ৫৭ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণ করে (এল.এ.কেস নং ৯/৮০-৮১) এবং দু’বছরের মধ্যে গুদামের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। বিনিময়ে তিনি সরকারে কাছ থেকে ৭ হাজার ১৪১ টাকার চেক (নং ১৬৫৬০৩ তাং ১১ এপ্রিল ১৯৮৩) গ্রহণ করেন। এ সত্ত্বেও বিষয়টি গোপন রেখে হুমায়ুন ২০১৪ সালের ৮ জুন তার বাবা আবুল হোসেনের কাছ থেকে ওই সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে নেয়।

ভেটখালী খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূর-ই-আলম বাংলানিউজকে জানান, সম্পূর্ণ ভূয়া কাগজের উপর ভিত্তি করে গত বছর ওই সম্পত্তিতে হুমায়ুন কাটা তারের বেড়া নির্মাণ করে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে ৩/১০/২০১৪ ও ৯/১০/২০১৪ তারিখে তার বিরুদ্ধে দখল সরিয়ে নিতে দু’দফা নোটিশ জারি করা হয়। কিন্তু কোনো নোটিশেরই তোয়াক্কা করেননি তিনি। উল্টো হাইকোর্টে গিয়ে সচিব ভূমি মন্ত্রণালয়, ডেপুটি কমিশনার সাতক্ষীরা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), শ্যামনগর এবং ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা কৈখালী-কে বিবাদী করে একটি রিট পিটিশন (নং ৯১৯৬, ২২ মার্চ ২০১৪) দায়ের করেন। এর জবাবে হাইকোর্ট ওই সম্পত্তিতে ৬ মাসের জন্য স্থিতাদেশ দেন। কিন্তু হুমায়ুন নিজেই সেই আদেশ অমান্য করে দখল করা জায়গায় পাকা মাকের্ট নির্মাণ করেন। সরকারি সম্পত্তি রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ায় হুমায়ুন কবীর, তার সহযোগী আব্দুল করিম, ইমান আলী ও আবু সালেহসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীরা তাকে হুমকি দেয় ও ভয়ভীতি দেখায়। উকিল নোটিশও পাঠায় রিট ফাইলকারী আইনজীবী শামসুল হক।

এসব ঘটনা উল্লেখ করে শ্যামনগর থানায় একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সম্প্রতি গুদাম কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কালিগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মীর মনির হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হুমায়ুনকে ওই অবৈধ স্থাপনা দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে তাও অগ্রাহ্য করে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে হুমায়ুন।

অপরদিকে, হুমায়ুন বাহিনী মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রমজাননগর ইউনিয়নের একটি পরিবারের ৪টি মাছের ঘের দখল ও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হত্যার হুমকি দেওয়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে ওই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নাসিমা বেগম হেনা অভিযোগ করে বাংলানিউজকে বলেন, সন্ত্রাসী হুমায়ুন আব্দুল করিম, আব্দুল গফুর, আবু সালেহ, ঈমান আলী, মুনসুর, সাইফুর, ফারুক, আজিজ, লাভলুসহ একাধিক সন্ত্রাসীর সহযোগিতায় ১৫, ১৬ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি তাদের চারটি ঘের দখল ও লুটপাট করে। হুমায়ুন বাহিনীর ভয়ে তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বর্তমানে  পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এ সুযোগে সন্ত্রাসীরা তাদের বসতবাড়ি দখল করার জন্য পিলার টানিয়েছে।

তিনি বলেন, এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দেওয়া হলে অজ্ঞাত কারণে পুলিশ আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

ইউপি সদস্য নাসিমা বেগম হেনা আরও বলেন, হুমায়ুনের বিরুদ্ধে কথা বললেই নানাভাবে হয়রানি করেন তিনি। ঠিক এভাবেই ২২ ফেব্রুয়ারি হুমায়ুন তার মা হালিমা খাতুনকে দিয়ে সাতক্ষীরা কোর্টে ভুক্তভোগী পলাতকদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা দায়ের করেছে। একই ব্যক্তি (হালিমা খাতুন) ২০০৭ সালে একই পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা করে। ওই মামলায় আসামিরা হাজত খাটলেও শেষ পর্যন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

এলাকাবাসী আরও জানান, হুমায়ুন ভূয়া কাবিননামা তৈরি করে স্থানীয় এক তরুণীকে বিয়ে (২য়) করে। প্রায় এক বছর ভোগ লালসা চারিতার্থ করে সম্প্রতি ওই তরুণীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এখন ওই তরুণী বিচারের আশায় পথে পথে ঘুরছে।

স্থানীয় একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বারবার রাজনৈতিক পরিচয় পরিবর্তন করা বাহিনী প্রধান হুমায়ুনের উত্থান শিবিরের হাত ধরে। ফয়সল আবাদ মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ও আগরদাড়ী মাদ্রাসায় পড়াকালীন ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। হিলফুল ফুজুল কমিটি সদস্য হিসেবে যোগদিয়ে পরবর্তীতে তিনি শিবিরের মাদ্রাসা ও ইউনিয়ন শাখার গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত নেতা গাজী নজরুল ইসলাম শ্যামনগরের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদ সদস্যের ক্যাডার বনে যান তিনি। জড়িয়ে পড়েন নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।

ওই সময় খাস জমি বরাদ্দের নামে গরীব মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ, থানার দালালি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, জমি দখলসহ নানা কাজে ব্যবহারে গড়ে তোলে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।

এরপর ২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি নেতা গোলাম রেজা সাংসদ নির্বাচিত হলে হুমায়ুন রাতারাতি ভোল পাল্টে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পান রমজাননগর ইউনিয়নে বিভিন্ন প্রকল্প তদারকির কাজ। সাংসদের ঘনিষ্ট হওয়ার সুবাদে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, পুলিশি ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে জায়গা জমি দখলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন হুমায়ুন।

ওই সময় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে অংশ নিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় তিনি। প্রতিশোধ নিতে হুমায়ুন ও তার বাহিনী হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নির্যাতন শুরু করে। কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে সাংসদের আশির্বাদে আবারও ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে আসে এলাকায়। কিন্তু সাংসদ গোলাম রেজা দলীয় প্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে হুমায়ুন ধীরে ধীরে তার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং আওয়ামী লীগ ঘরানার লোকজনের কাছে যাতায়াত শুরু করে। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ভেটখালী খাদ্যগুদামের জায়গা দখলে নেওয়ার পায়তারা শুরু করে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, খাস জমি বরাদ্দ দেওয়া ও বিদেশে পাঠানোর নামে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে হুমায়ুন। পাশাপাশি নাশকতা ও গাছ কাটা কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে আদায় করছে টাকা।

হুমায়ুন বাহিনীর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মীর মনির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে এবং হুমায়ুনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্থাপনা তুলে নিতে। যদি তিনি নির্দেশ না মানেন তবে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে, হুমায়ুনের পক্ষে পুলিশি পাহারার বিষয়টি মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য স ম জগলুল হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, হুমায়ুন কবীর আওয়ামী লীগ কর্মী নন। খাদ্য গুদামের জায়গা উদ্ধারে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছি। জায়গা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

তবে, এ ব্যাপারে হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা করলেও মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।