গত বছর থেকেই বড় পরিসরে বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়বারের মত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যূথবদ্ধভাবে মেলা অনুষ্ঠিত হলো।
আয়োজকের সঙ্গে প্রকাশকের, প্রকাশকের সঙ্গে লেখকের কিংবা লেখকের সঙ্গে পাঠকের; বলা বাহুল্য, ব্যক্তিবিবেচনায় কারও জবাবই কারও সঙ্গে মিলবে না।
কিন্তু শ্রেণীগত জায়গা থেকে কিছু বিষয় হয়ত প্রতিবারের মতই ‘কমন’ পড়বে। যথা, আয়োজক কর্তৃপক্ষের মনে হবে, মেলা সফলভাবে অনুষ্ঠিত। প্রকাশকরা মনে করবেন, আয়োজন পরিকল্পনায় প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে আরও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা যেত।
আবার প্রকাশকের স্বচ্ছতা ও বইয়ের রয়্যালিটি ইত্যাদি বিষয়ে হয়ত প্রশ্ন তুলবেন লেখক। তেমনি লেখকের লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য প্রস্তুত থাকবেন পাঠক।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এবার যে বিষয়টি কাঁপিয়ে তুলেছে সবাইকে—নিঃসন্দেহে তা, বইমেলায় এসে অভিজিতের খুন হওয়ার ঘটনা। আর মাত্র দু’দিনের মেলা বাকি তখন, ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে টিএসসির সামনে ধারালো চাপাতি দিয়ে খুন করা হলো বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে।
ঠিক ১১ বছর আগেও, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বেরিয়ে আসার পর খুন করা হয়েছিল প্রথাবিরোধী লেখক, শিক্ষক ও ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদকে।
সম্ভবত আমরা কেউ-ই সেই শোকস্মৃতি ভুলে যাই নি। আর সে কারণেই হয়ত আজ প্রশ্ন উঠছে, বইমেলা তবে প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনষ্ক লেখকদের খুন হবার আদর্শ জায়গা হয়ে উঠছে কিনা।
তা না হলেও এটা ঠিক যে, সহজেই সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে বইমেলা হয়ে উঠছে একটি সুবিধাজনক জায়গা। গত তিনটি বইমেলার দিকে তাকালে আমরা এই বক্তব্যের সত্যতা উপলব্ধি করব।
২০১৩ সাল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ কেন্দ্রিক বইমেলা আয়োজনের শেষ বছর। এরপর ২০১৪ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বইমেলা আয়োজিত হতে শুরু করে। সে বছর ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নেয় গণজাগরণ মঞ্চ।
পরবর্তীতে সমালোচিত হলেও দেশের প্রগতিশীল লেখক বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণ সমর্থন ছিল ওই আন্দোলনে। অনেকেরই আশঙ্কা, এ সমর্থনের জের ধরেই সেবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বইমেলায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতের ওই অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় মেলার ২৫টি স্টল।
গত বছর ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অব্যাহত হরতাল অবরোধেও ফেব্রুয়ারির বইমেলা আয়োজন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। অনেক প্রকাশকই ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা করছিলেন, পাঠক-দর্শনার্থী মহলেও ছিল নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা।
অবশ্য জাতীয় নির্বাচনের পর হরতাল অবরোধ তুলে নেওয়ায় সেবারের বইমেলা আয়োজনে বড় কোনও বাধা থাকে নি আর।
কিন্তু এ বছর বইমেলা শুরুই হয় দেশব্যাপী টানা হরতাল-অবরোধ আর যত্রতত্র অগ্নিসংযোগের মহোৎসবের মধ্যে। যে কারণে মেলার উদ্বোধনী ভাষণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই বলেন, ‘কোত্থেকে যেন একটুকরো কালো মেঘ এসে ঘিরে ফেলে আমাদের। ’ এছাড়াও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রায় সকল বক্তার বক্তব্যেই ঘুরে ফিরে আসে প্রসঙ্গটি।
কিন্তু উদ্বোধনী দিনটি অব্যাহত অবরোধ এবং টানা ৭২ ঘণ্টা হরতালের শুরুর দিনে পড়ায় মেলায় জনশূন্যতার যেই আশঙ্কা ছিল—বইপ্রেমী মানুষের মুহুর্মূহু আগমনে মাঠে ধুলো উড়িয়েই সেই আশঙ্কা ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়।
১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রথম দিনই পাঠক-ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ।
এ সম্মিলন আশাবাদী করে তোলে সবাইকে। শেষদিন পর্যন্তও উল্লেখযোগ্য লোকসমাগম হয় বইমেলায়। প্রায় প্রতিদিনই আশেপাশে ফুটতে থাকা ককটেল, জ্বলতে থাকা যানবাহন আর পুড়তে থাকা মানুষের কান্না সঙ্গে নিয়েও বইমেলায় ছুটে আসে হাজার হাজার বইপ্রেমী মানুষ। ব্যর্থ হতে দেয় না প্রাণের মেলাকে।
এবারের মেলায় বই বিক্রির সংখ্যাই উপরোল্লিখিত বক্তব্যের পক্ষে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রমাণ। বাংলা একাডেমিসহ সব প্রকাশনী মিলে এবারের মেলায় প্রায় ২২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। গতবছরের তুলনায় যা সাড়ে ৫ কোটি টাকা বেশি। উল্লেখ্য, গতবছর মেলায় বিক্রি হয়েছিল সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বই।
সুতরাং অনায়াশেই বলা যায়, একজন লেখকের খুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেখানে কিছুই করার থাকে না, আয়োজক কর্তৃপক্ষ যেখানে আগতদের জন্য একটি ধূলিমুক্ত, পরিচ্ছন্ন মেলা উপহার দিতে পারে না, প্রকাশকরা যেখানে লেখকের টাকায় মানহীন বই প্রকাশ করে করে বিভ্রান্তিতে ফেলে পাঠকদের। সেখানে এই একটি পরিসংখ্যানই জিতিয়ে দিচ্ছে প্রাণের বইমেলাকে।
বলা বাহুল্য, সাধারণ ক্রেতা পাঠকরাই উক্ত পরিসংখ্যানটির মহান বাস্তবায়ক। আর এসকল নায়কদের দিয়েই হয়ত বারবার ঘুরে দাঁড়াবে বইমেলা। আমাদের প্রাণের বইমেলা।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৫