ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মাঘ ১৪৩১, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ক্ষুধায় কাঁদে রোমিও!

জান্নাতুল ফেরদৌস,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৫
ক্ষুধায় কাঁদে রোমিও! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: যখন বেশি  (বেশি) ক্ষুধা লাগে তখন চোখ দিয়ে টপটপ কইরা পানি পরতে থাহে রোমিওর। কি করুম।

সব সময় তো খাওন যোগান দিবার পারতাছি না। ’
ছলছল চোখে কথাগুলো বললেন পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের ঘোড়া ব্যবসায়ী নাজিমউদ্দৌলা।

তিনি রোমিও, মাহি, পঙ্খীরাজ, কুতুবসহ ১২টি ঘোড়ার মালিক।

রোমিও কাঁদে ক্ষুধার জ্বালায়, আর নাজিমউদ্দৌলা কাঁদেন রোমিও মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে। রোমিওর মত একই অবস্থা বাকি ঘোড়াগুলোরও।  

উইলিয়াম শেক্সপিয়রের গল্পে জুলিয়েটের ভালোবাসা কাঁদিয়েছেল প্রেমিক রোমিওকে। আর পুরান ঢাকার এই রোমিও ক্ষুধা লাগলে পেটের জ্বালায় কাঁদে। তার কষ্টে কাঁদেন তার মালিক নাজিমউদ্দৌলা। মালিক খেতে দিতে না পারলে ক্ষুধার জ্বালায় নীরবে কাঁদে রোমিও।

রোববার (১ মার্চ) দুপুরে পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের ঘোড়া ব্যবসায়ী নাজিমউদ্দৌলার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। অশ্রুসিক্ত চোখে ধরা গলায় নাজিমউদ্দৌলা জানান, প্রায় দুই মাস ধরে উপার্জন বন্ধ। ঠিকমতো খেতে দিতে পারছেন না ঘোড়াগুলোকে। খেতে দিতে না পারলে নীরবে শুধু চোখের পানি ফেলে তারা। প্রতিবাদও করে না ঘোড়াগুলো।  

সৌখিন মানুষেরা বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া করে থাকেন ঘোড়া। সপ্তাহে দুইটি ঘোড়া ভাড়া হলে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় হয় নাজিমউদ্দৌলার। এর মধ্যে থেকে চালক ও চালকের সহকারীকে দেওয়ারপর লাভ থাকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু হরতাল- অবরোধে লাভ তো দূরের কথা বরং ঋণ করেই পালন করতে হচ্ছে এদের।

এই ঘোড়া ব্যবসায়ী জানান, সহিংসতার আশঙ্কায় কেউ ঘোড়া ভাড়াও করতে চান না, আবার টমটমও রাস্তায় বের করা যায় না। এতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভীষণ কষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে ঘোড়াগুলোকে। ‍

তাই তো অসহায় সুরে নাজিমউদ্দৌলা বলেন, ঋণ করে আর কত খাওয়ামু এদের। নিজেগো লগেও তো একখান কইরা পেট আছে। সংসার আছে। কেমনে চলতাছি কেওরে বোঝাইবার পারি না। ’

নাজিমউদ্দৌলা  আরও জানান, মাহি, পঙ্খীরাজ, কুতুবসহ বিভিন্ন নামে ১২টি ঘোড়া রয়েছে তার। হরতালে এদের সবাইকে বসে বসে খাওয়াতে হচ্ছে।   এদিকে খাওয়ার অভাবে ঘোড়াগুলোর শক্তিও দিন দিন কমে যাচ্ছে।

সাধারণত ঘাস, ছোলা, বুট এগুলোই ঘোড়ার খাবার। তবে তাদের প্রিয় খাবার বাবলি। এটা খেলে খানিকটা তেজি হয়ে উঠে ঘোড়া।   কিন্তু হরতালে-অবরোধে বাবলি তো দূরের কথা ঠিকমতো ঘাসও খেতে দিতে পারছেন না মালিকরা। এরপরেও প্রতিটি ঘোড়ার খাবার যোগান দিতে প্রতিদিন তার প্রায় ছয়শ’ টাকা খরচ হয় বলে জানান নাজিমউদ্দৌলা।

রোমিও নামের এই ঘোড়াটি তিনি কিনেছিলেন ভারতের রাজস্থান থেকে। ছোটবেলায় দুরন্ত ছিল বলে আদর করে এর নাম দিয়েছিলেন রোমিও। কিন্তু অভাবের কারণে রোমিওকে বিক্রি করে দিতে হয় কি-না এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলেন তিনি।

নাজিমউদ্দৌলা বলেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে ঘোড়া বিক্রি করে খেতে হবে তাকে। এদিকে বাপ-দাদার ব্যবসা, তাই ছাড়তেও পারছেন না।

১৫ বছর বয়সী আরেক ঘোড়ার নাম মাহি। সবচেয়ে শান্ত ও চালাক হওয়ায় এটিকে শ্যুটিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়।

নাজিমউদ্দৌলা জানান, গত বছর ‘খোঁজ দ্য সার্চ’ সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্য ভাড়া করা হয়েছিল মাহিকে। কিন্তু এবার ভয়ে কেউ শুটিংয়ের জন্যও ভাড়া করতে আসেননি কেউ। ’ 

তিনি বলেন, বছরের প্রথম দুই মাস তাদের ব্যবসা চাঙ্গা থাকে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি মৌসুমে তারা তেমন সুবিধা করতে পারেননি। কবে দেশের অবস্থা ভালো হবে আর কবে তারা ঋণ শোধ করবেন- এটাই এখন তাদের ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কথা হল ফুলবাড়িয়া ওভার ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা টমটম চালক রুবেলের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সবগুলো গাড়িই পড়ে রয়েছে।   আগে গড়ে প্রতিদিন ভাড়া পেতেন এক থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এখন তিন বেলা খাবারের টাকাও ওঠে না। সারাদিনই টমটমের ওপর বসে থাকতে হয়।

আনন্দ বাজারের টমটম চালকের সহকারী সাব্বির জানান,আগে প্রতিদিন আয় হত দুশ’ থেকে তিনশ’ টাকা। এখন ৫০ টাকাও পকেটে ভরতে পারেন না। আয় নেই দেখে অনেকদিন ধরে বাড়িও যেতে পারেননি।

পুরান ঢাকার আরও কয়েকজন ঘোড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীতে শুধুমাত্র পুরান ঢাকাতেই টমটমের প্রচলন রয়েছে। পুরো এলাকায় প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি ঘোড়া রয়েছে। এসব ঘোড়ার মালিক প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন।

আগের মতো চাহিদা না থাকায় দিন দিন কমছে ঘোড়া ব্যবসায়ীদের সংখ্যা। এভাবে দেশের অবস্থা চলতে থাকলে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা শুরু করবেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শফিউল্লাহ, ইব্রাহিমসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা।

তবে সরকারের সহযোগিতায় খুব দ্রুত দেশে শান্তি ফিরে আসবে। একই সঙ্গে আগের মতো রাজধানীতে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার টমটমও চলবে এমনটিই প্রত্যাশা তাদের।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৭ ঘণ্টা, ০১ মার্চ, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।