ঢাকা: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উত্তর কোরিয়ার এক কূটনীতিকের লাগেজ থেকে ২৭ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় উদ্বিগ্ন কাস্টমস কর্মকর্তারা। বিমানবন্দরে কোনো কূটনীতিকের লাগেজ থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
বৃহস্পতিবার (০৫ মার্চ) রাত সাড়ে ১০টার দিকে উত্তর কোরিয়ার হাইকমিশনের ফার্স্ট ইকোনোমিক ফর কমার্শিয়াল সেক্রেটারি সন ইয়ং ন্যাম’র লাগেজ থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় শাহজালালে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার (০৬ মার্চ) সকাল পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে বিমানবন্দর কাস্টমস, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দফায় দফায় বৈঠক করেন।
শুক্রবার দুপুরে স্বর্ণগুলো জব্দ করে সন ইয়ং ন্যামসহ তাকে রিসিভ করতে আসা অপর চার কূটনীতিককে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আর্মড পুলিশের ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) তানজিনা আখতার বাংলানিউজকে বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে আসা সন ইয়ং ন্যাম’র লাগেজ থেকে ২৭ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার হয়। এ সময় চার কূটনীতিক তাকে রিসিভ করতে আসেন। পরবর্তীতে ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী (বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত কূটনীতিকদের বিশেষ নিয়ম-নীতি) তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখবে।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সং ইয়ং ন্যাম সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ ৪৪৬ নামে একটি ফ্লাইটে শাহজালালে অবতরণ করেন। পরে তিনি ইমিগ্রেশন শেষ করে গ্রিন চ্যানেল পার হওয়ার সময় কাস্টমস কর্মকর্তারা তার ট্রলি ব্যাগটি স্ক্যান করতে চান। এসময় তিনি নিজের পরিচয় না দিয়ে লাগেজটি স্ক্যানে বাধা দেন।
লাগেজ স্ক্যানে বাধা দেওয়ার বিষয়টি সন্দেহ হলে কাস্টমস কর্মকর্তারা তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। এসময় তিনি নিজের পরিচয় না দিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এবং বলেন, এটি কূটনৈতিক লাগেজ, তাই স্ক্যান করা যাবে না। এক পর্যায়ে তিনি দ্রুত গ্রিন চ্যানেল পার হয়ে আসেন। পরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা তাকে আটক করে এপিবিএন অফিসে নিয়ে যান।
এ সময় তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকা বাংলাদেশে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার হাইকমিশনার মুন সং হো, ফার্স্ট সেক্রেটারি কো চো মিন, থার্ড সেক্রেটারি রি চোল সান, ডেপুটি চিফ অব মিশন কেং কিং এপিবিএন অফিসে যান। কিন্তু তারা নিজেদের পরিচয় না দিয়ে ন্যামকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাস্টমস কর্মকতাদের বারবার চাপ দিতে থাকেন।
এ সময় তারা একটি কূটনৈতিক পেপারস দেখিয়ে সেটি স্ক্যান না করার জন্য বলতে থাকেন। এই অবস্থায় খবর পেয়ে এপিবিএন’র কমান্ডিং অফিসার (সিও) রাশেদুল হাসান, কাস্টমস কমিশনার হোসেন আহমেদ, যুগ্ম কমিশনার কাজী মুহাম্মদ জিয়াউদ্দীনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে ছুটে আসেন।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে এই অবস্থা চলতে চলতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে এপিবিএন কর্মকর্তারা ওই পাঁচ কূটনীতিককে লাগেজ রেখে চলে যেতে বলেন। এতেও তারা রাজি হননি।
এ সময় কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, ১ থেকে ২০ পর্যন্ত গণনা হবে, এই সময়ের মধ্যে যদি তিনি লাগেজ স্ক্যান করতে না দেন, তাহলে বল প্রয়োগ করা হবে। কাউন্টডাউনের ৮ এ এলে সং ইয়ং ন্যাম লাগেজটি হাত থেকে ফ্লোরে রেখে দেন। এরপর এপিবিএন সদস্যরা কৌশলে লাগেজটি স্ক্যান করতে নিয়ে যান। লাগেজটি স্ক্যানে দেওয়া মাত্রই স্বর্ণের অস্তিত্ব মেলে। এরপর সেটি খুলে ১৭০ পিস বার (ওজন ১৯ কেজি) ও ৮ কেজি ওজনের স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়।
এদিকে, ব্যাগ থেকে স্বর্ণ পাওয়ার পর ওই পাঁচজনকে পুলিশ হেফাজতে কাস্টমস হলে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তারা নিজেদের উত্তর কোরিয়ার কূটনীতিক বলে পরিচয় দেন। দীর্ঘ প্রায় ৬ ঘণ্টা পর কূটনীতিকরা নিজেদের পরিচয় দেওয়ায় উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যান।
কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রথমে বিষয়টি বিশ্বাস করতে না পেরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খবর দেন। এমন খবর শুনে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও ছুটে আসেন। পরে তারা নিশ্চিত করেন, স্বর্ণ বহনকারী সং ইয়ং ন্যামসহ পাঁচজনই উত্তর কোরিয়ার কূটনীতিক।
এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের কর্মকর্তা, কাস্টমসের কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা দীর্ঘ সময় ধরে দফায় দফায় বৈঠক করার পর ভিয়েনা কনভেনশনের আইন অনুযায়ী স্বর্ণগুলো জব্দ করে ওই পাঁচ কূটনীতিককে ছেড়ে দেন।
স্বর্ণসহ কূটনীতিক আটকের ঘটনা জানাজানি হলে বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। স্বর্ণ চোরাচালানে কূটনীতিকদের জড়িত থাকার ঘটনায় এ সময় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, কূটনীতিকদের লাগেজ স্ক্যান করার নিয়ম নেই। কিন্তু এই সুযোগ নিয়ে তারা যদি অবৈধ পণ্য আনেন তাহলে সেটি দুঃখজনক ও উদ্বেগের বিষয়। এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলেও তারা মন্তব্য করেন।
স্বর্ণগুলো জব্দ করা হয়েছে নিশ্চিত করে বিমানবন্দর কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার কাজী মুহাম্মদ জিয়াউদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, এটি সত্যিই উদ্বেগজনক ঘটনা। তবে আমাদের সতর্কতার কারণে বিষয়টি ধরা পড়েছে। এ ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের করণীয় ঠিক করবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৫