ডা. দীপু মনি (এমপি)। দেশের প্রথম ও একমাত্র নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সাবেক)।
ঢাকা: ‘ছেলেবেলা থেকেই জানতাম আমি রাজনীতিক হব। আর এজন্য মানুষের পাশে থাকতে হবে--বাবার এমন পরামর্শে ডাক্তার হয়েছি। এরপর জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী, এমনকি আইনজীবীও হয়েছি মানুষের জন্য রাজনীতি করার জন্য। ’
রাজনীতিক ও ভাষাবীর এম ওয়াদুদের কন্যা ডা. দীপু মনির বলিষ্ঠ উচ্চারণ শুনেই বোঝা গেল ‘আত্মবিশ্বাস’ তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
পারিবারিক পরিবেশের কারণে কখনোই শুরুর সেপথটাকে বন্ধুর মনে হয়নি দীপু মনির। ‘নারী’ বলে ‘পারব না’-- মনোভাবও ছিল না। তবুও রাজনীতির মাঠে নানা প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। এই প্রতিকূলতা যতটা রাজনীতিক হিসেবে, তারও চেয়ে বেশি ‘নারী’ হিসেবে।
এ-প্রসঙ্গে দীপু মনি বলেন, বাবার কারণে রাজনীতিকরা অনেকেই স্নেহ করতেন আমাকে। কিন্তু দলীয় পদ পাওয়ার পরই জীবনে প্রথম বাধার মুখোমুখি হই। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হওয়ার পরে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। এই ঈর্ষা আরো বেড়ে যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর। আমাকে প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে অনেক রকমের বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন অনেকে। কিন্তু তাদের কাছেও আমি খুব কৃতজ্ঞ। কারণ, যত তারা বাধার প্রাচীর তৈরি করেছেন, ততই সে প্রাচীর ডিঙিয়ে যাওয়ার কৌশল শিখেছি আমি।
তিনি বলেন, সকল বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছি। ছোট থেকেই বাবার অনুপ্রেরণায় নিজেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি ভেবে বড় হয়েছি। নিজেকে যা কিছুর জন্য তৈরি করব, আমি তা-ই করতে পারব ভেবেই এগিয়েছি।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান বলে বিশেষ কোনো কোটায় নয়, বরং মেধা আর যোগ্যতার কারণেই শেখ হাসিনার প্রিয় পাত্রতে পরিণত হয়েছেন দীপু মনি। পেয়েছেন দলীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ।
নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে দীপু মনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে একটু বাড়তি সুবিধাই পেয়েছি বলতে হবে। আগ্রহ নিয়ে সবাই কথা শুনেছেন। বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশ বাংলাদেশে নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেখে, বাইরের দুনিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণাই সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছি শুধু নিজের দেশে। সেটা আমাদের কারো কারো চিন্তার দীনতার কারণে। সহযোগিতার বদলে তারা ছোট করার, হেয় করার চেষ্টা করেছেন। এর কিছুটা নারী হওয়ার কারণে, আবার কিছুটা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন, কাছের মানুষ হওয়ার কারণেও। শেখ হাসিনাকে যারা মাইনাস করতে চেয়েছিল, তারাই তার কাছের মানুষদের তার থেকে দূরে সরিয়ে তাকে একা করতে চেয়েছে।
সমুদ্রজয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারী সেনাপতি সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে তিনিই লড়েছিলেন সমুদ্রজয়ের সেই ঐতিহাসিক আইনি যুদ্ধ।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমারের অগোচরে তাদের বিরুদ্ধে ভিন্ন দুটি আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। লড়াইয়ের জন্য গড়েন সেরা আইনজীবীদের দল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেসব আদালতে বসে শুনানি শুনেছেন। বিচারকার্য দেখেছেন। যা দেখে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন খোদ বিচারকরাও।
এ প্রসঙ্গে দীপু মনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার নির্দেশে কাজ করে সমুদ্রে প্রায় বাংলাদেশে আয়তনের সমান এলাকা জয় করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবেই-এমন ইতিবাচক মানসিককতা নিয়ে এগিয়েছিলাম আমরা। তাই সমুদ্রে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সমুদ্রসম্পদ আহরণ করাসহ তা কাজে লাগাতে যে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন তা-ও জয় পাওয়ার আগেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিয়ে ফেলেছিলাম। সমুদ্র সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা, আহরণ ও কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ জনবল গড়তে তিনটি মেরিন একাডেমি থেকে ২২টিতে উন্নীত করা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিষয়ক বিভাগ খোলা, একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ইনিস্টিটিউট স্থাপনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। একইসঙ্গে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়।
তিনি বলেন, আমাদের দাবি ছিল ন্যায়সঙ্গত। তাই যতটুকু দাবি করেছিলাম, ততটুকুই আমরা পেয়েছি।
ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট রেখেই সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি, ভারতের সঙ্গে তিস্তা ও স্থল সীমানা চুক্তি বাস্তবায়নের মত বিষয় গুছিয়ে আনার পরেও দীপু মনির নিন্দুকেরা থেমে থাকেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দিনের পর দিন বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
কিন্তু দেশের প্রয়োজনে, বিগত সরকারগুলোর তৈরি করা দুর্নাম ঘোচাতেই দিনের পর দিন কষ্টাদায়ক সব ভ্রমণের পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে জানান সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এবং এর ফসল হিসেবে অতীতের সব নেতিবাচক পরিচয় ঘুচিয়ে বাংলাদেশের সঠিক এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সফল বাংলাদেশের চিত্রটি সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পায় বলে দাবিও করেন দীপু মনি।
২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মত আওয়ামী লীগও যখন চরম বিপাকে তখনও পাশে থেকেছেন দীপু মনি। শেখ হাসিনা আটক হওয়ার পর অনেকের মত দলের একটি অংশও চেয়েছিল দল থেকে তাকে (শেখ হাসিনাকে) মাইনাস করতে। কিন্তু কোনো প্ররোচনার ফাদেঁ না পড়ে নেত্রীর হয়ে লড়েছিলেন দীপু মনি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনীতির দু:সময়ে রাজনীতির কর্মী হিসেবে নেত্রী, দল ও দেশের প্রতি প্রতি অঙ্গীকাবদ্ধ ছিলাম বরাবরই। দেশের জন্য, দলের জন্য সে অঙ্গীকার, আনুগত্য ও ভালবাসা প্রমাণের সময় এসেছিল ২০০৭-০৮ সালে। দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ও নেত্রীর মুক্তির জন্য কাজ করেছিলাম। নেত্রীর নেতৃত্বে গণতন্ত্র ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছি আমরা।
দীপু মনি নারীদের অগ্রগতির পথে ধর্মীয় বাধা প্রসঙ্গে বলেন, ইসলামকে যারা ভালভাবে বোঝে তাদের কাছে ধর্ম কোনো বাধাই হতে পারে না। কারণ, ইসলাম ধর্ম যিনি প্রথম গ্রহণ করেছিলেন তিনি নারী, ইসলামের জন্য যিনি প্রথম শহীদ হয়েছিলেন তিনিও একজন নারী। এছাড়া ইসলামের প্রতিটি বিজয়ের পিছনে নারীদের অবদান উল্লেখযোগ্য।
মেধাবী দীপু মনি মিশনারী স্কুল-কলেজে পড়ায় তখন রাজনৈতিক দলে নাম লেখাতে পারেননি। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে ভর্তি হওয়ার দিনই রাজনীতিতে নাম লেখান। অতলে হারিয়ে যাননি। কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করেন সকল একাডেমিক কার্যক্রম।
সে বর্ণনা দিতে গিয়ে স্মৃতি হাতড়ে দীপু মনি বলেন, সারাদিন বন্যা আক্রান্তদের জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, চিড়া মুড়ি প্যাকেট করার পর সারারাত পড়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি এলএলএম-এর জন্য। এভাবে রাজনীতি করার ফাঁকে ফাঁকে সবকিছুই ঠিকমত শেষ করেছি।
তবে যারা রাজনৈতি পরিবার থেকে না এসে রাজনীতি করছেন তাদের জন্য পথটি বেশ কঠিন--- স্বীকার করেন তিনি। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এর ট্রাস্টি বোর্ডের এই সদস্য নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, বাধা আসবেই। তবে সেটাকে পেরিয়ে যেতে হবে অসীম সাহসে। নিজেকে নারী বলে পিছিয়ে গেলে বা হাত গুটিয়ে থাকলে চলবে না। নিজের যে শক্তি, তার প্রতি আস্থাশীল ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজের যোগ্যতা বা দক্ষতার কথা প্রথমে নিজেকেই বলতে হবে, প্রমাণ করতে হবে। জানাতে হবে পৃথিবীকে। দোদুল্যমানতায় ভুগলেই তুমি পিছিয়ে পড়বে।
একাধারে চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী, আইনজীবী ও রাজনীতিক দীপু মনি শিক্ষকতা ও গবেষণাও করেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি কমনওয়েলথ মিনিস্টেরিয়াল অ্যাকশন গ্রুপের প্রথম নারী ও দক্ষিণ এশীয় চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য দীপু মনি নারী উন্নয়ন, নারীস্বাস্থ্য, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করেন।
মেধাবী এই রাজনীতিক ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএইচ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম করেছেন। জন হপকিন্স ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বন্দ্ব নিরসন ও সমঝোতা বিষয়ে বিশেষ কোর্সও করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত দুটি বইও প্রকাশিত হয়েছে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনির।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৫
জাতীয়
নারী দিবস উপলক্ষে সাক্ষাৎকার
যত বাধার প্রাচীর, তত বাধা ভাঙার কৌশল: দীপু মনি
জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।