ঢাকা: প্রতি বছর ৮ মার্চ দিবসটি পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারীদিবস হিসেবে। বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবসটি উদযাপন করে থাকেন।
নারীদিবসে ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের জীবনের পথচলার গল্প উপস্থাপন করা হচ্ছে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য। ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। কিন্তু সকল বাধা পেরিয়ে কিছু সৌভাগ্যবান নারী পেয়েছেন তাদের কাঙ্ক্ষিত পথের দিশা। তাদেরই একজন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক সাবিনা খাতুন।
ঢাকার মাঠে হালি হালি গোল করার খ্যাতি আছে সাবিনার। এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ১৪ গোল করার রেকর্ড রয়েছে এই গোলমেশিনের। সাতক্ষীরার এই ফুটবলার গেল নভেম্বরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে চার ম্যাচে চার গোল করেছিলেন। চার গোলের দুটি করেছিলেন মালদ্বীপের বিপক্ষে।
সেদিন সাবিনার ক্রীড়া নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন মালদ্বীপের ফুটবল কোচ ও কর্তারা। ফলে দ্বীপরাষ্ট্রটির সুনজর পড়ে সাতক্ষীরার এ তরুণীটির উপর। শেষ পর্যন্ত মালদ্বীপ পুলিশ ক্লাব তাকে তাদের দলে চুক্তিবদ্ধ করে নিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মাধ্যমে।
বিদেশের মাটিতে খেলতে যাওয়াকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি অর্জন বললে ভুল হবে না। বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী মো: সালাহউদ্দিন বিদেশি ক্লাবের হয়ে খেলতে যাওয়া প্রথম বাংলাদেশি ফুটবলার। সাবিনা খাতুন হলেন বিদেশে খেলতে যাওয়া প্রথম বাংলাদেশি নারী ফুটবলার।
৪০ বছর আগে এমন এক ইতিহাস গড়েছিলেন দেশের অন্যতম সেরা ফুটবলার সালাহউদ্দিন। ১৯৭৫ সালে তিনি হংকংয়ের পেশাদার লিগে এফসি ক্যারোলিনের হয়ে খেলেছিলেন। তখন সালাহউদ্দিন আবাহনীর হয়ে খেলতেন।
মালদ্বীপের পুলিশ ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন সাবিনা। ফলে বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটালেন সাবিনা আর তাতে নিজের নামটি লিখলেন সোনার আখরে। আর পারিশ্রমিকটাও বেশ ভালো, প্রায় ৮০০ ডলার। এর ফলে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলে জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার গেল খুলে।
গত ৪ মার্চ মালদ্বীপ পুলিশ ক্লাবের পক্ষে খেলতে গেছেন তিনি। মালদ্বীপে অনুষ্ঠেয় ফুটবল টুর্নামেন্ট 'ক্লাব মালভিজ ওম্যান ফুটসাল ফিয়েস্তা ২০১৫' চলবে ১৪ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, সাবিনা খাতুন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং বিদেশের কোনো ক্লাবের হয়ে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ফুটবলার। আন্তর্জাতিক আসরে সাবিনার গোল ১০টি। এসএ গেমস, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্ব, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, অলিম্পিক প্রি-কোয়ালিফাইং রাউন্ডসহ অনেক টুর্নামেন্টে খেলেছেন ২২ বছর বয়সী এই ফুটবলার।
ঘরোয়া ফুটবলে গোলের সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়েছে বেশ আগেই। এ পর্যন্ত সাবিনার গোলসংখ্যা ১১৬টি। তিনি শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের হয়েও খেলেছেন। প্রায় চার বছর ধরে জাতীয় দলে সহ-অধিনায়কের দায়িত্বটা পালন করে আসছেন দেশসেরা অন্যতম এ ফরোয়ার্ড।
সাবিনার জন্ম ১৯৯৩ সালের ২৫ অক্টোবর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পলাশপুর গ্রামে। বাবা সৈয়দ গাজী, মা মমতাজ বেগম। বাবা-মা’র পাঁচ কন্যার মধ্যে সাবিনা চতুর্থ। ২০১১ সাল থেকে সাবিনা বিজেএমসিতে চাকরি করেন। যদিও সেখানে তিনি চাকরি করেন অ্যাথলেট হিসেবে। তারপরও ফুটবলের প্রতি ছিল তার অদম্য আগ্রহ। ২০০৯ সালে যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন তখনই শুরু করেন ফুটবল খেলা।
আকবর স্যারের (সাতক্ষীরা জেলা ফুটবল দলের কোচ) হাত ধরেই বেড়ে ওঠা তার। আজ দেশের নারীদের জন্য গৌরবের প্রতীক তিনি। খেলেছেন স্কুল পর্যায়ে, আন্তঃস্কুল ও আন্তঃজেলা পর্যায়েও। সেখানে ভাল খেলার সুবাদে ডাক পান জাতীয় দলে।
সাতক্ষীরা থেকে সাবিনাসহ মোট ছয়জন জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত বাছাইয়ে কেবল সাবিনাই টিকে যান। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে টানা খেলছেন তিনি।
সাবিনার পরিচিতি মূলত স্ট্রাইকার হিসেবেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুরুতে তিনি ছিলেন মিডফিল্ডার! তবে কোচের পরামর্শে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলতে শুরু করেন। এ পজিশনে খেলে যে কোনো ভুল করেননি, তার প্রমাণ ২০১০ সালে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে পুরস্কার পাওয়া। ওই আসরে গ্রুপ পর্যায়ে শ্রীলঙ্কাকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ম্যাচে সাবিনা করেছিলেন একটি গোল।
ব্রাজিলের প্রমিলা ফুটবল তারকা মার্তাকে আদর্শ মানেন বাংলাদেশ নারী ফুটবলের অন্যতম সেরা এই ফরোয়ার্ড। ঘরোয়া লিগ বা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার সময় প্রায়শই দেখা যায়, প্রতি ম্যাচেই তার দল ২৭-২৮টি করে গোল করছে। যার অর্ধেক গোল আসে সাবিনার পা থেকে!
উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়া সাবিনা সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়ালেখা করতে চান। সেই সঙ্গে খেলার পাশাপাশি চালিয়ে যেতে চান চাকরিটাও।
সাবিনার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য একটাই। সবাই যেভাবে এক নামে আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর লিওলেন মেসিকে চেনেন, ঠিক সেইভাবে পাঁচ বছর পর দেশের সবাই চিনবে সাবিনাকেও। শুভ হোক সাবিনার পথচলা। আগামী দিনগুলোতে তিনি দেশের ফুটবলের জন্য বয়ে আনুক সাফল্যের বার্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৫