ময়মনসিংহ: স্বামীর অবর্তমানে বিধবা রীতা (৪০) আর অসুস্থ স্বামীর বদলে সংসারের ঘানি নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া তারা বানু (৪৫) আন্তর্জাতিক নারীদিবসের কর্মসূচিতে যাবেন না। রোববার সকাল ১০ টায় যখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য র্যালি বের হবে, তখন তারা শহরের গোহাইলকান্দি এলাকায় ইট ভাঙবেন।
‘নারীর ক্ষমতায়ন, মানবতার উন্নয়ন’--নারীদিবসের এ প্রতিপাদ্যের সারমর্ম তাদের কেউ কখনো বলেনি। বছর ঘুরে বারবার এ দিবস এলেও কখনো র্যালি, আলোচনাসভা কিংবা কর্মসূচিতে তাদের ডাক পড়ে না। ফলে নারীদিবস কী এটাও জানেন না তারা।
প্রায় এক যুগ ধরে হাড়ভাঙা কাজ করে সংসার চালালেও তাদের ভূমিকা কোথাও দৃষ্টান্ত হয়নি। দিন-রাত পরিশ্রমের পরেও পাননি মানবতার ছোঁয়া। বরং অমানবিকভাবেই হয়েছেন শ্রম বৈষম্যের শিকার। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা প্রান্তিক পর্যায়ের এ নারীদের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চরকালিবাড়ি এলাকায় থাকেন রীতা (৪০)। স্বামী মারা গেছেন ৪ বছর আগে। প্রতিদিন কাজে আসার সময় বৃদ্ধা মা’র কাছে নিজের একমাত্র শিশুকন্যাকে রেখে আসেন।
অন্যদিকে একই এলাকার তারা বানু’র স্বামী ইদ্রিস অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে আছেন ৩ বছর হলো। ৩ মেয়ে আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়েই তার সংসার। জীবন-জীবিকার পাশাপাশি প্রায় এক যুগ ধরে এ দু’নারী শহর ঘুরে ঘুরে ইট ভাঙার কাজ করেন। এর মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তারা সংসারের আয়েরও একমাত্র যোগানদাতা।
আগে খাবার নিয়ে দু:খ কষ্ট থাকলেও এখন আর সেটা নেই। শত কষ্টেও সংগ্রামী এ প্রান্তিক নারীদের মুখের হাসি ম্লান হয়নি। কিন্তু সমাজ সংসারে এখনো আঙুল তুলে তাদের দিকে যেন তাকিয়ে থাকে পুরুষতান্ত্রিক চোখ।
পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিত্য কাজ করেও মজুরি পান কম। দলনেতা পুরুষ শ্রমিকের কাছেই মজুরি বন্টনের ক্ষমতা থাকায় তারা এ মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা দলনেতা নূর হোসেনের (৫০) সঙ্গেই শহরের গোহাইলকান্দি এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের জন্য এক সপ্তাহ যাবত ইট ভাঙার কাজ করছেন তারা বানু ও রিতা। আলাপচারিতায় তারা নিজেরাই তুলে ধরেন মজুরি বৈষম্যের কথা।
তারা বানু বলেন, ‘পুরুষ শ্রমিকের সমানই তো কাম করি। মহিলা দেইখ্যা মজুরি কম দেয়। এইড্যা অহন মাইন্ন্যা নিছি। ’
শনিবার প্রখর খরতাপে তখনো নিবিষ্ট মনে হাতুড়ি দিয়েই ইট ভেঙে চলছিলেন রিতা। খানিকটা রেগে গিয়ে তারা বানুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘পুরুষের চেয়ে আমাগর দাম কম। একজন পুরুষ যেখানে দৈনিক ৩’শ টাকা পায় সেইখানে আমগরে দেয় ২৫০ টাকা। সমান কাম করলেও সমাজ আমাগরে ঠিক মূল্য দেয় না। ’
কথা বলার সময় চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল তার দুই গাল বেয়ে। সেই জলের সঙ্গে যেন বেরিয়ে এলো নিজের জীবনের এমন কষ্টগাথা। নারীদিবসের সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যারা কথা বলেন তাদের দৃষ্টিতে আসেন না রীতা আর তারা বানুর মতো প্রান্তিক নারীশ্রমিকরা। ফলে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন।
‘নারীদিবস কী জানেন?’-প্রশ্ন করতেই যেন আবার মুখ খুললেন তারা বানু: ‘আমরা এইসব দিবস-টিবস বুঝি না। কাম করি, ভাত খাই। যতদিন বাইচ্যা থাকমু এ ইটভাইঙাই জীবন চালাইতে অইবো। আমগরে কেউ তো এইত্যা দিবস লইয়্যা আইজ পর্যন্ত কিছুই কয় নাই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৫