ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

মেধা আর যোগ্যতাই তার সাফল্যের সিঁড়ি

জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৫
মেধা আর যোগ্যতাই তার সাফল্যের সিঁড়ি

ঢাকা: সাইদা মুনা তাসনিম। থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।

একই সঙ্গে জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি।

তিনিই প্রথম নারী, ‍যিনি অলঙ্কৃত করলেন এ পদ। সম্প্রতি হয়েছেন এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এআইটি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে জানালেন তার সাফল্যের বিভিন্ন সিড়ির কথা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাশ করে গতানুগতিক নিয়মে প্রকৌশল পেশাই বেছে নিয়েছিলেন সাইদা মুনা তাসনিম।

কিন্তু সরকারি চাকুরীজীবী (অতিরিক্তি সচিব) বাবার আগ্রহে পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় বসেন তিনি।

বিসিএস একাদশ ব্যাচে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে যোগ দেন  পররাষ্ট্র ক্যাডারে।

সীতাকুন্ডের মেয়ে মুনা তাসনিম পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেন ১৯৯৩ সালে। পরের বছর বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে সব ক্যাডারের মধ্যে প্রথম হয়ে অর্জন করেন রেক্টরস অ্যাওয়ার্ড। ২২ বছর ধরে কূটনীতিক জীবনে পালন করে চলেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্ব।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন ও লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনে গুরুত্বপূর্ণ পদেও কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে ছিলেন পাঁচ বছর। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।

সফলতার এই সিঁড়িতে চড়ার পেছনে নিজের তিনজন পুরুষের অবদানের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করলেন মুনা। বললেন, বাবা, স্বামী এবং ভাইয়ের অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতা ছাড়া কোনো ভাবেই এ পর্যন্ত আসা সম্ভব ছিল না।

তবে একেবারেই সহজ ছিল না তার যাত্রা। নানা প্রতিবন্ধতা পার করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে মেধাবী এই কূটনীতিক বলেন, নারী হিসেবে শুধু চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করতে হয়েছে। একজন নারীকে পুরুষের তুলনায় তিনগুন কাজ করে তার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আজও ‘নন ট্রাডিশনাল’ পদগুলোতে নারীরা স্থান পায় না। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই সমান যোগ্যতা নিয়েও তারা এসব পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নারীরা যেন অদৃশ্য এক ‘হাত কড়া’য় আবদ্ধ।

সাইদা মুনা তাসনিম বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে নারীর ক্ষমতায়নে এগিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু আজও দেশে অর্থ, স্বরাষ্ট্র, সামরিক, বিদ্যুত কিংবা পররাষ্ট্র সচিবের মতো চ্যালেঞ্জিং পদগুলোতে নারীদের ভাবা হয় না। সমাজ কল্যাণ, নারী ও শিশুমন্ত্রণালয় বরাদ্দ থাকে তাদের জন্য।

‘এসব পদে পুরুষরাই বসবে-এটাই যেন ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এসব পদ চালানোর মতো মেধাবী এবং দক্ষ নারীও আছেন, ’—যোগ করেন তিনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে এই ইতিহাসে রাষ্ট্রাচার প্রধান (চিফ অব প্রটোকল), প্রশাসন বহিঃপ্রচার বিভাগের মহাপরিচালক বা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও কোনো নারীকে বসতে দেওয়া হয়নি। অথচ একই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নারীরাও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন।

তবে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে একজন নারীকে বাছাই করেন। সে পদে বসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা প্রকাশিত করে তার যোগ্যতার প্রমাণ দেন মুনা তাসনিম। প্রথা ভেঙে এ কাজটি করার জন্য সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান তিনি।

পেশাগত দায়িত্ব পালনে নারীদের আত্মত্যাগের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, অফিসের পাশাপাশি পরিবার, সমাজও সামলাতে হয় তাকে। এভাবে বিচার করলে সমাজে নারীর অবদানটাই বেশি। কিন্তু সেভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। বরং একটি নির্দিষ্ট তালিকার বাইরের দায়িত্ব ‘নারীদের জন্য নয়’ বলেই ধরে নেওয়া হয়।

‘তবে এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বেই’ উল্লেখ করে করে অভিজ্ঞ এই কূটনীতিক বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বের সিংহভাগ অংশে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীরা বসতে পারেনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরে মতো উন্নত রাষ্ট্রও পরিপূর্ণভাবে এ প্রথা ভাঙতে পারেনি। এখন অনেক নারী বাইরে সফলভাবে কাজ করছে, কিন্তু চেয়ারপারসন বা সিইও হচ্ছে ক’জন? মাত্র ৫ শতাংশ। যখন সব নন ট্রাডিশনাল পদে যোগ্য নারীরা স্থান পাবে তখনই ভাবতে পারবো সমাজে নারীদের একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ’

কোনো বিশেষ কোটায় নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতেই নারীদের প্রাপ্য স্থান দেওয়ার পক্ষে এই নারী রাষ্ট্রদূত।

চাকরির পরিবর্তে শিক্ষায় কোটা রাখার পক্ষে মুনা তাসনিম। যাতে চাকরির ক্ষেত্রে মেধাবীদেরই যোগ্য স্থানটি জোটে।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মুনা বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূরণে কয়েক বছরে নারী নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছেন। নারী স্পীকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে নারী ভিসি, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে নারী সচিব নিয়োগ এ পরিবর্তনেরই বার্তা। নারী ক্ষমতায়নের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এমন মানসিকতার জন্যই আমি আজ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব্ব পালন করছি। আর এ জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা সকল নারীর পক্ষ থেকে।

নারী নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তার অনুপ্রেরণা বলেও জানান মুনা।

‘আশা করছি অল্প দিনেই আমরা আরও নন ট্রাডিশনাল পদে আরো যোগ্য নারীদের দেখতে পাবো,’—আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

মুনা তাসনিম বলেন, এখন নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। যে অদৃশ্য হাতকড়া দক্ষ নারীদের পিছিয়ে রেখেছে, সে হাতকড়া থেকে অবশ্যই মুক্তি মিলবে। যোগ্যতা দিয়েই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় স্থান করে নেবেন নারীরা। কারণ এখন চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে নারীদের।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৫

** নারীর হাতে গাড়ি, নিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।