ঢাকা: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মো: বদিউজ্জামানের এখতিয়ারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামাল হোসেন। নোটিশে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি কমিশনারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, তারা চেয়ারম্যানের আইন বহির্ভূত কাজকে অবৈধভাবে সমর্থন দিচ্ছেন।
রোববার(৮ মার্চ’২০১৫) দুদক চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া এ নোটিশ কমিশনার, দুদক সচিব, দুদকের সকল মহাপরিচালক এবং পরিচালককের কাছেও পাঠিয়েছেন এ আইনজীবী। কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নোটিশের বিষয়ে বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন।
নোটিশের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার(তদন্ত) মো: সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বাংলানিউজকে বলেন, আজ (রোববার) এ সংক্রান্ত নোটিশ পেয়েছি। তবে বিস্তারিত না পড়ে মন্তব্য করতে চাই না। ’
এদিকে রোববার দুদকের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে এ নোটিশ পাওয়ার পর সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দুপুরে এ নোটিশ পাওয়ার পর বিকেল পর্যন্ত দুদকের পদস্থ কর্মকর্তাদের মাঝে এটি ছিল মূল আলোচনায়।
নোটিশে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, কমিশনের অন্য সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। এতে করে দুদক আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। এছাড়া দুদক আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে এ আইনি নোটিশে।
দুদক আইন ২০০৪ এর ৫(১) ধারা অনুযায়ী ‘কমিশন ৩ জন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত হইবে এবং তাহাদের মধ্য হইতে রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করিবেন। ’ রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করলেও কমিশনের সংজ্ঞায় চেয়ারম্যানকেও একজন কমিশনার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, আইনের ২(খ) ধারা অনুযায়ী ‘কমিশনার’ অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো কমিশনার। এ অনুযায়ী চেয়ারম্যানও একজন কমিশনার। আইনের ১৪ ধারায় ‘কমিশন সভা’ সম্পর্কে চেয়ারম্যানকে কিছু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আইনের ১৪(১), ১৪(২) এবং ১৪(৩) ধারায় বিধানাবলী সাপেক্ষে সভার কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ, সভা আহ্বান, সভার স্থান ও সময় নির্ধারণ এবং সভায় সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব চেয়ারম্যানের।
বিধান অনুযায়ী কমিশন স্বাধীন হলেও দুই কমিশনারকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে ‘প্রধান নির্বাহী’র কাছে। পদাধিকার বলে দুদকের প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন ‘চেয়ারম্যান’। ফলে দুই কমিশনার স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। অথচ ‘কমিশনার’ হিসেবে ৩জনেরই {চেয়ারম্যান, কমিশনার( তদন্ত) ও কমিশনার(অনুসন্ধান)} কাজের এখতিয়ার সমান। কিন্তু আইনের ১২(১), ১২(২) ধারার আওতায় সংঘটিত কার্যক্রমে চেয়ারম্যানের একক কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রয়োগের অবকাশ রয়েছে। প্রশাসনিক কার্যক্রমে অন্য কমিশনারদের মতামত নেয়া হয় না।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কমিশনারদের কাছে অবহিতকরণের লক্ষ্যে একটি চিঠি দেয়া হয়। যা আইনের ১৫ ধারার পরিপন্থী। দুদক আইনের ১৫(১) ধারায় ‘কমিশনের সিদ্ধান্ত’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘কমিশনের সকল সিদ্ধান্ত উহার সভায় গৃহীত হইতে হইবে। ’ ‘সকল সিদ্ধান্ত’ বলতে অনুসন্ধান, মামলা, তদন্ত অনুমোদন, চার্জশিট, ফাইনাল রিপোর্ট, প্রশাসনিক কার্যক্রম, আর্থিক বিষয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও বিভাগীয় ব্যবস্থাকেও বোঝায়। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, মামলার অনুমোদন ছাড়া সব সিদ্ধান্তই চেয়ারম্যান এককভাবে গ্রহণ করছেন।
আইনের ১৪(৪) ধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যানসহ দুইজন কমিশনারের উপস্থিতিতে সভার কোরাম গঠিত হতে পারে। ফলে কোরাম হওয়া মাত্র কমিশনের এক সদস্যকে বাদ দিয়েই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে যাবতীয় কার্যক্রম শেষে বিষয়টি উত্থাপিত হচ্ছে কমিশন সভায়। অথচ ‘স্বাধীন কমিশন’র ধারণা অনুযায়ী, যে কোনো বিষয়ে কার্যক্রম শুরুর আগেই দুই কমিশনার অবহিত এবং অনুমোদন দেয়ার আবশ্যকতা থাকার কথা।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, আইনের ১২(১) ধারায় চেয়ারম্যানকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, কমিশন আইনে চেয়ারম্যানকে কমিশনের সভায় সভাপতিত্ব ও সময় স্থান নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মাত্র {ধারা ১৪ (২) (৩)। আবার ১৬ (২) ধারার বিধানে সুস্পষ্ঠভাবে কমিশনের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে।
এ বিষয়টি উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়, উপরোক্ত সকল বিধান সমন্বয় করলে চেয়ারম্যানের সভার সভাপতিত্ব ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নোটিশে সংযুক্ত কাগজাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চেয়ারম্যান কমিশনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই বেআইনিভাবে প্রধান কার্যালয়সহ আন্ত:জেলা বদলি, পদায়ন এমনকি বিভাগীয় শৃঙ্খলা জনিত শাস্তিমূলক মামলাসমূহ কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই প্রদান করেছেন।
নোটিশে আরও বলা হয়েছে, দুদক বিধিমালা ২০০৭ এর ২২নং বিধিতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, কমিশন সরকারের নিকট কোন সরকারি কর্মকর্তাকে প্রেষণের জন্য অনুরোধ করতে পারবে। তবে বিধিতে কমিশন আইনের কোথাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা উল্লেখ নেই কিন্তু অতীতে দুদকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ছিল এখনও আছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়েছে-‘এ বিষয়ে কমিশনকে জবাবদিহি করার সুযোগ রয়েছে। ’
দুদক আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী কমিশনের কাজ পরিচালনা না করলে ভবিষ্যতে জনস্বার্থে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে হুশিয়ারি দিয়ে কমিশনকে বলা হয়, ‘সকল পরিণতির জন্য আপনারা পৃথক ও এককভাবে দায়ী থাকবেন’।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৫/ আপডেটেড ২০২১ ঘণ্টা