ঢাকা: সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। বাংলাদেশের সংবিধানেও সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে নারীকে।
সংবিধানের ৭(২) ধারায় বলা হয়েছে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেটা আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। ’
এর পরেও উত্তরাধিকার সম্পত্তি আইনে ধর্মীয় আইল বহাল রয়েছে।
সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় আইন পরিবর্তন করা হলেও মুসলিম সমাজে উত্তরাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে হানাফি আইন অনুসরণ করা হয়। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী সমাজে হিন্দু ‘উত্তরাধিকার সম্পত্তি’ আইন বহাল রয়েছে।
শুধু মাত্র খ্রিস্টান আইনে নারীর সমান অধিকার দেওয়া হলেও অন্য ধর্মের ক্ষেত্র উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে এখনও সমান অধিকার নিশ্চিত হয়নি।
নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের প্রণীত নীতিমালায় বলা হয়, ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরি বিষয়াদি, যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, উপার্জনের সুযোগ, উত্তরাধিকার, সম্পদ, ঋণ-প্রযুক্তি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদসহ ভূমির ওপর অধিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ ও সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া এবং সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা। ’
পরবর্তীতে ২০০৪ সালে তৎকালীন চার দলীয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার উক্ত নীতিমালায় ‘উত্তরাধিকার’, ‘সম্পদ’ এবং ‘ভূমির উপর অধিকার’ কথাটি বাদ দিয়ে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪ প্রণয়ন করে।
পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৭ ও ২০০৪ সালের নীতিমালার আলোকে ’উত্তরাধিকার’ এবং ‘ভূমির উপর অধিকার’ শব্দগুলো বাদ দিয়ে ‘বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ’ কথাটি যোগ করে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮ ঘোষণা করে।
নারী নীতি সম্পর্কে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিপ্লবী নারী সংহতির সমন্বয়ক শ্যামলী শীল বলেন, নারী নীতিতে নারীর অধিকার নিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। নারী নীতি ২০১১ তে উত্তরাধিকার সম্পাত্তিতে সমান অধিকার না দিয়ে, ‘উত্তরাধিকার’ সূত্রে পাওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তিতে সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। যা নারীর প্রতি চরম বৈষম্য।
শুধু তাই নয়, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য রুখতে দলিল সিডো আইনের যে সব ধারা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলোকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ তাতে স্বাক্ষর করেছে।
সাংবিধানিকভাবে সমান অধিকারের কথা বলা হলেও উত্তরাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন অনুসরণ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জেলিনা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যের উদাহরণ হচ্ছে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার না দেওয়া।
সংবিধানে যেখানে অঙ্গীকার করা হয়েছে যে মৌলিক অধিকারে অসামঞ্জস্য সব আইন বাতিল করা হবে। সেখানে শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন বহাল রেখে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বার্থ উদ্ধার করা হচ্ছে।
ধর্মীয় বিধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ধর্মীয় বিধান পরিবর্তন করা হয়েছে । ব্রিটিশ-ভারতে ১৯৩৭ সালে প্রণীত ‘মুসলিম আইন উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে দাদা বা নানার আগে যদি বাবা/মা মারা যান তাহলে দাদার বা নানার সম্পত্তি বাবার অন্য ভাইয়েরা ভোগ করত।
কিন্তু যুগের চাহিদার সাথে ১৯৬১ সালে সে আইন পরিবর্তন করে বাবা/মা মারা গেলেও তার উত্তরাধিকাররা সম্পত্তির মালিক হবার বিধান করা হয়েছে। তখন কোন বাধা ছিল না। কারণ সেখানে পুরুষের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৬১ সালের মুসলিম আইনে পুরুষের চার বিবাহের বিষয়টি পরিবর্তন করে সালিশ পরিষদের সম্মতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। স্বামীর মত স্ত্রীকেও তালাক দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিবাহের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। বিধি লঙ্ঘনকারীর শাস্তি বিধান করা হয়েছে। স্বামী দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকলে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী নারী স্বামীকে তালাক দিয়ে পুনরায় বিয়ে করতে না পারলেও ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন পরিবর্তন করে ‘কোন ব্যক্তি চার বছর নিখোঁজ’ থাকলে স্ত্রী স্বামীকে আদালতের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। শুধু মাত্র উত্তারাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকারের কথা বললে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মাথা নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সংবিধানের ২৮ ধারায় উল্লেখ আছে, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণেও কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। বাস্তব তার উল্টো। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় আইন পরিবর্তন হলেও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ক্ষুন্ন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৫