ঢাকা: রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন দেখি, কেউ নিয়ম ভঙ্গ করছেন, তখন খারাপ লাগে। আমরা সবাই যদি নিয়ম মানার চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উত্তর বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মেরিন আখতার অনেকটা আক্ষেপের সুরে এ সব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ঝোঁকে পড়ে একটা সরকারি চাকরি ছেড়ে পুলিশে এসেছি। গত কয়েক বছর ধরে ট্রাফিকের উত্তর বিভাগে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা যখন কর্মকর্তারা রাস্তায় থাকি, তখন কিছু নিয়ম না মানার বিষয়টি চোখে পড়ে। কিন্তু আমরা যখন রাস্তায় থাকি না, সে সময় ফের আগের অবস্থায় চলে যায়।
মেরিন আখতার বলেন, যখন আমরা নিয়ম মানার জন্য বলি, তখন অনেকেই আমাদের খারাপ বলেন। কিন্তু, আমরা সবার ভালোর জন্যই বলি। তারা যেন নিরাপদ, ভালো থাকেন, সে চেষ্টাই নিরন্তর করে যাই।
তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে আমি নিজেকে কখনই নারী ভাবি না। আমি চেষ্টা করি, নিজের দায়িত্ববোধ থেকে সব সময় ভালোটা করার।
রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক বিমানবন্দর সড়ক। ডিএমপির উত্তর বিভাগের ব্যস্ততম এই সড়কটি রোদ, বৃষ্টি ঝড়েও নিরাপদ রাখতে সর্বদা তৎপর এই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।
একজন নারী হিসেবে ট্রাফিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কেমন লাগছে, কেনই-বা পুলিশে আসা, সে বিষয় নিয়েই খোলামেলা কথা বলেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মেরিন আখতার।
মেরিন আখতারের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের বাশাইল থানার কাশেল গ্রামে। বাবা ইব্রাহিম জিয়া ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একজন কর্মকর্তা। পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় মেরিন আখতার। ভাই-বোনের মধ্যে বেশির ভাগই সরকারি কর্মকর্তা।
মেরিন আখতার পড়াশুনা করেছেন গ্রামের কেবিএন হাইস্কুলে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন সরকারি সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে। এরপর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
পুলিশ হওয়ার প্রতি বিশেষ ঝোঁকের কারণে ২৭তম বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে পুলিশের চাকরি শুরু করেন। পুলিশের বিভিন্ন বিভাগেও কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বর্তমানে ট্রাফিকের উত্তর বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগেও ইতোমধ্যে তিনি সুনাম অর্জন করেছেন।
সরকারি একটি চাকরি ছেড়ে কেন পুলিশে আসা এমন প্রশ্নের উত্তরে মেরিন আখতার বললেন, আমার সব সময়ই এই পেশার প্রতি বিশেষ একটা ঝোঁক ছিল। আমি মনে মনে ভাবতাম, আমি পুলিশ হবো।
কেন হবো এটা না বলতে পারলেও পুলিশের অফিসার হওয়ার ইচ্ছেটাই এতদূর নিয়ে এসেছে বলেও মনে করেন তিনি।
কেমন লাগছে এই পেশা- এর উত্তরে মেরিন আখতার বলেন, বাংলাদেশে পুলিশের চাকরি সব সময়ই একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। আর এই পেশায় দিনরাত নেই। নেই কোনো ডিউটি সিডিউল। সমস্যা হলে আপনাকে ঘর থেকে বেরুতে হবে।
তিনি বলেন, তবে আমি কখনোই চাই না সমস্যা হোক। অনেক সময় বাড়ি ফেরার পর পোশাক (ইউনিফর্ম) পাল্টাতে না পাল্টাতে আবার চলে আসতে হয়েছে। এই কাজে বিশেষ একটা আকর্ষণও আছে। আসলে যে এটা করে না, সে এটা বুঝবে না।
পরিবারের পক্ষ থেকে সমস্যার কথা বলতে তিনি বলেন, পরিবার আমাকে ফুল সাপোর্ট (পুরোপুরি সহযোগিতা) করে। সাপোর্ট না করলে এই চাকরি আর করা যাবে না।
তিনি বলেন, আমি মানুষের সেবা করার জন্যই এই পেশায় এসেছি। সুতরাং পিছুটান থাকলে তো আর সেটা সম্ভব হবে না।
কর্মক্ষেত্রে নিজের সামাজিক অবস্থানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। এই নারীরা যদি পুরুষের পাশাপাশি কাজে না আসেন তবে দেশ তো আগাবে না। সুতরাং দেশকে আগাতে হলে সমানে সমান হতে হবে। আর কর্মক্ষেত্রে কখনোই আমি নিজেকে নারী ভাবি না।
তিনি আরো বলেন, আমার ভাবনায় থাকে, কী করে আমি আমার পেশা ও দায়িত্বের প্রতি অবিচল থেকে সেবা দিতে পারবো; সেই চেষ্টাই করে যাই।
নারীদের উদ্দেশে এই পুলিশ কর্মকর্তা মেরিন আখতার বলেন, আমি নারীদের বলবো, নিজেকে নারী ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। যে কোনো কাজ পুরুষের পাশাপাশি আপনিও করতে সক্ষম, এমনভাবেই নিজেকে গড়ে তোলেন। যে পেশাই হোক, পেশার প্রতি সম্মান রেখে কাজ করে যেতে হবেই।
নিজেকে নারী হিসেবে বিবেচনা করে কম কাজ বা কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তবেই আপনি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা হয়ে নারীদের প্রতি এ আহ্বান রাখেন ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উত্তর বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মেরিন আখতার।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৫