ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

নারী মুক্তিযোদ্ধা পারুল

চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নারীর সমতা

অশোকেশ রায়, অ্যাক্টিং আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১১ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৫
চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নারীর সমতা মুক্তিযোদ্ধা পারুল আক্তার

ঢাকা: যে আশা-আকাঙ্খা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি, তা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরেও যখন নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষকে পেট্রোল বোমায় মারা যেতে দেখছি, নারীকে দেখছি পদানত হয়ে থাকতে, তখন নারী হিসেবেই শুধু নয়, এদেশের একজন নাগরিক হিসেবেও আক্ষেপ হয়।

অনুশোচনা হয়, এজন্যই কি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম? 

আন্তর্জাতিক নারী দিবস’২০১৫ কে সামনে রেখে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নারী মুক্তিযোদ্ধা পারুল আক্তার এ আক্ষেপ করে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে পারলে কেটে যাবে এ অন্ধকারের অমানিশা।    

ভারতের বিখ্যাত গোবরা নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলে দেশকে মুক্ত করার যুদ্ধে বিজয়ী এই বীর নারী যোদ্ধা চান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নারী-পুরুষের সমতা, ঘরে-বাইরে কর্মক্ষেত্রে নারী অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের পুরোপুরি বাস্তবায়নও।

নারীদের নিয়ে আশাবাদী সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা পারুল আক্তার বলেন, মৌলবাদকে ‌উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছে এদেশের নারীরা। অর্থনীতি ও কৃষিক্ষেত্রে অবদান রাখছে, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিয়ে রক্ষা করছে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করছে। সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমেও নারীর অবদান রয়েছে। আজকের সাহসী নারী সাংবাদিকতায়ও অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

বর্তমান সরকার উন্নয়নের মূল ধারায় নারীকে যথাযথভাবে কাজে লাগাচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়ে নিচ্ছে সফলভাবে। সংসদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সরকারের নীতিনির্ধারণী কার্যক্রমেও এগিয়ে নারীরা।

তবুও আক্ষেপ রয়ে গেছে পারুল আক্তারের। তার কষ্ট, তৃণমূলে এখনো নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, পরিবারে হচ্ছে নিগৃহীত-অবহেলিত। বৈষম্যও রয়েছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। এগুলোর অবসানে, নারী-পুরুষ সমতা ও সম অধিকার বাস্তবায়নে দেশ আরও এগিয়ে যাবে- নারী দিবসে এটাই পারুলের প্রত্যাশা।    

রনাঙ্গনে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে মুজিবনগর সরকার এবং ভারত সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতায় কলকাতার পদ্মপুকুর এলাকার গোবরায় আজকের সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় যাত্রা শুরু করে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ‘গোবরা ক্যাম্প’ নামে পরিচিত এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেন একাত্তরের সতের বছরের তরুণী পারুল, যিনি তখন সুন্দরবন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।

পারুল আক্তার জানান, গোবরা ক্যাম্পে আমাদের দেওয়া হয় তিন ধরনের প্রশিক্ষণ। সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং এবং অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধক্ষেত্রে আমার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি এম মাখদুমা নার্গিস রত্না, নির্মলা সেন, কৃষ্ণা রহমান, লক্ষ্মী রানী, ঝর্না, বিথি-যুথি দুই বোন, জিয়াউন্নাহারসহ ২৬৪ নারী যোদ্ধাকে।

পারুল বলেন, গোবরা ক্যাম্পে প্রথম সারির প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে সফলভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে ভারত সীমান্তবর্তী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলোতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে অংশ নেই। সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি নারী যোদ্ধাদের নিয়ে বিভিন্ন সীমান্তে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসেবা দিয়েছি, ওষুধপত্র সরবরাহ করেছি।

বাগেরহাটের কৈখালী সীমান্তে বিভিন্ন যুদ্ধ ও অভিযানে আমাদের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সোহরাবউদ্দিন। কৈখালী সীমান্তকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই মুক্ত রেখেছিলাম। কৈখালী দখলের জন্য প্রায়ই সেখানে পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ চালাতো। আর এ আক্রমণ ঠেকাতে ভারতীয় সেনারাও সাহার্য করতেন আমাদের।

স্মরণীয় যুদ্ধ সম্পর্কে পারুল বলেন, যুদ্ধের সূচনা পর্বে ‘গোবরা ক্যাম্পে’ প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার আগেই খুলনার গল্লামারী বেতার কেন্দ্র দখলের যুদ্ধে অংশ নেওয়া ছিল আমার জন্য সবচেয়ে গৌরবের। মেজর জয়নাল আবেদীন, রহমতউল্লাহ দাদু ও মুজিব বাহিনীর খুলনা জেলা প্রধান কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে যুদ্ধক্ষেত্রে আমার সহযোদ্ধা ছিলেন কে এম জালালউদ্দিন, মো. সোহরাব আলম ও মো. মনজুরুল আলমসহ অনেকে।

এরপর মুজিব বাহিনীর বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার দেয়াপাড়া ক্যাম্পে ক্যাম্প প্রধান এম এম জিয়াউল ইসলামের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেই। এ দুই ক্যাম্পের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সময়কালেই পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে চলে যায় খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চল। তাই আমরা আরও অধিকতর প্রশিক্ষণ নিতে চলে যাই গোবরা ক্যাম্পে।  

১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনার বাগমারায় জন্ম পারুল আক্তারের। বাবা ময়েজউদ্দিন শেখ ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মা পেয়ারা বেগম গৃহিণী।

স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সব পড়াশোনা করেছেন খুলনাতেই। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন। সে চেতনা থেকেই তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া।  

১৯৭৭ সালের ২০ এপ্রিল খুলনায় সোনালী ব্যাংকে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু। এখনো তিনি ব্যাংকটিতে কর্মরত মতিঝিল প্রধান শাখার কর্মকর্তা হিসেবে।

স্বামী অবসরপ্রাপ্ত টিঅ্যান্ডটি কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন, দুই ছেলে ব্যবসায়ী-বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিরত মাসুদ পারভেজ ও আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটির শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ রনিকে নিয়ে সংসার জীবন পারুল আক্তারের। আরো আছেন বড় পুত্রবধূ ও দুই নাতি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রত্যয়ে শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর আন্দোলনের সঙ্গে তিনি কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। জড়িত রয়েছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও।

মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পারুল আক্তার বললেন, একাত্তরের সাহসিকা নারী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আত্মত্যাগ করেছে, লাঞ্ছিত হয়েছে এদেশে আরও লাখো-কোটি মা-বোন। পুরুষের পাশে থেকে যেহেতু মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছে নারীরাই, সেহেতু দেশ গড়ার সুমহান কাজেও সফল হবে আজকের নারী।

মমতাময়ী নারী, স্নেহময়ী নারী, মুক্তিকামী নারী মানবতার মহাজীবনে তাই সফল হবে- এ আশাবাদ ও দৃঢ়প্রত্যয় এই নারী যোদ্ধার।   
 
বাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।