ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের শুনানি আগামী ১ এপ্রিল শুরু হবে।
সোমবার (০৯ মার্চ) সকালে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্ঝ আসামিপক্ষের আইনজীবীর সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ দিন ধার্য করেন।
বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড মোলভী ওয়াহিদুল্লা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আদালতে চার সপ্তাহের সময়ের আবেদন জানান মৌলভী ওয়াহিদুল্লা। এ আবেদনের শুনানিতে তিনি বলেন, এ মামলার অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নাল আবেদীনের পক্ষে আমি এসেছি। আমাদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে এখন এ মামলার শুনানি করতে পারছেন না। তাই আমাদের সময়ের প্রয়োজন।
এ সময় আদালত বলেন, এই মামলার শুনানি দ্রুত করার জন্য নিয়ম রয়েছে। সংসদ এ বিষয়ে কনসার্ন। এ মামলায় মুলতবির কোনো সুযোগ নেই।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আসামিপক্ষের আনইজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ছাড়াও আরও আইনজীবী রয়েছেন। এর মধ্যে এম শাহজাহান রয়েছেন।
এ সময় আদালত বলেন, আবেদনে খন্দকার মাহবুব হোসেনের নাম রয়েছে সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে। পরে আদালত আসামিপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করে ১ এপ্রিল শুনানির দিন ধার্য করেন।
গত বৃহস্পতিবার (০৫ মার্চ) সকালে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল মামলার চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনটি দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। পরে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতির আদালতে শুনানির দিন ধার্যের আবেদন জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (০৮ মার্চ) চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। বিকেলে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের প্রকাশিত কার্যতালিকায় রিভিউ আবেদনটির শুনানির দিন ধার্যের আদেশের জন্য সোমবার দিন ধার্য করা হয়েছিল।
সোমবারের কার্যতালিকায় রিভিউ আবেদনটি আসায় এদিনই শুনানি শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তবে আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানির দিন ১ এপ্রিল ধার্য করা হয়েছে।
রোববার তার চেম্বারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মাহবুবে আলম আরও বলেছিলেন, আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর রিভিউতে তা কমেছে বলে বাংলাদেশে কোনো ঘটনা আমি দেখিনি। এ ব্যাপারে আগাম কোনো মন্তব্য করা সঠিক না। আদালত কি করবেন, সেটা আদালতই জানেন।
এর আগে ২০১৩ সালে ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। তবে কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে রিভিউ করার বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। এবার আপিল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জন্য রিভিউ করার সময়সীমা ১৫ দিন নির্ধারণ করে দেন। সাধারণত রিভিউ করার সময় থাকে ৩০ দিন। এ ক্ষেত্রে শুনানি নিষ্পত্তির সময়ে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না।
মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তার খালাস চেয়েছেন আসামিপক্ষ।
কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন রিভিউ দাখিলের পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন, আপিল মামলার রায়ে একজন বিচারপতি ফাঁসির আদেশের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তার পয়েন্টগুলো ধরেই আমরা রিভিউ আবেদনের শুনানি করবো। ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে চার্জশিটভুক্ত (ফরমাল চার্জ) দশজন সাক্ষীর বাইরে রাষ্ট্রপক্ষের নতুন তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছিল। এটা নিয়েও শুনানি করবো।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির একই বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন।
এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ তিন বিচারপতি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম।
পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আইজিপি (প্রিজন) এর বরাবরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠান। পরে কারাগারে কামারুজ্জামানকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়।
গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডার কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
মুক্তিযুদ্ধকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন কামারুজ্জামান। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে এই বাহিনী ওই অঞ্চলজুড়ে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা মোট ৭টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মধ্যে সোহাগপুর গণহত্যার (৩ নম্বর অভিযোগ) দায়ে চূড়ান্তভাবে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া সোহাগপুর গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে অভিযুক্ত করলেও এ অভিযোগে তিনি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ডের পক্ষে মত দেন। সেই সঙ্গে ১, ২, ৪, ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী সর্বোচ্চ সাজার পক্ষে মত দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসামির দণ্ড নির্ধারিত হয় মৃত্যুদণ্ড।
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার (৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি। এ অভিযোগে ট্রাইবুন্যাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও সাজা কমিয়ে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
এ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়।
দারাসহ ছয় হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন ও অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের (২ নম্বর অভিযোগ) দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া এ সাজাও বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
তবে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান হত্যার (১ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন কামারুজ্জামান। এছাড়া ৫ নম্বর (১০ জনকে হত্যা) ও ৬ নম্বর অভিযোগে (টুনু হত্যা ও জাহাঙ্গীরকে নির্যাতন) ট্রাইব্যুনালের রায়ের সঙ্গে একমত হয়ে আপিল বিভাগও খালাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১৫/আপডেটেড: ১০১৮ ঘণ্টা
** কামারুজ্জামানের রিভিউ কার্যতালিকায়